এমটি কায়রোসে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা: কেমন আছেন বাংলাদেশি নাবিকরা?


২০২৫ সালের ৩০ নভেম্বর একটি মারাত্মক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় চীনা মালিকানাধীন এমটি কায়রোস জাহাজ। রাশিয়ার নভোরোসিস্ক বন্দরে ক্রুড অয়েল পৌঁছানোর পথে এই জাহাজটি কৃষ্ণ সাগর (ব্ল্যাক সি) অতিক্রমকালে তুরস্কের জলসীমায় ইউক্রেইনের ড্রোন বোট থেকে দুটি ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণের শিকার হয়। হামলার ফলে ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ এবং আগুন লেগে এমটি কায়রোস জাহাজটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়।

এ জাহাজে থাকা ২৫ জন নাবিকের মধ্যে ৪ জন বাংলাদেশি নাবিক ছিলেন—মাহফুজুল ইসলাম (চতুর্থ প্রকৌশলী), হাবিবুর রহমান (অয়েলার), আসগর হোসাইন (পাম্প ম্যান) এবং আল আমিন হোসেন (ডেক ক্যাডেট)। তবে তাদের সকলেই তুরস্কের ইজমিত শহরের একটি হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বর্তমানে সুস্থ। যদিও শারীরিকভাবে তারা সুস্থ, তবে মানসিকভাবে যে চাপ ও ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হয়েছে, তা সহজে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।

ক্ষিপ্ত আক্রমণের সময় যা ঘটেছিল

এই ভয়াবহ হামলার বিস্তারিত বর্ণনা দেন মাহফুজুল ইসলাম, যিনি বাংলাদেশ নেভাল অ্যাকাডেমির ৫৫ ব্যাচের ছাত্র। তিনি বলেন, ‘‘আমরা মিশরের পোর্ট সুয়েজ থেকে খালি জাহাজ নিয়ে রাশিয়ার নভোরোসিস্ক বন্দরের দিকে যাচ্ছিলাম। যখন আমরা কৃষ্ণ সাগরের ২৮ থেকে ৩০ নটিক্যাল মাইল দূরত্ব পার হচ্ছিলাম, তখন বিকাল ৪টা ৫০ মিনিটে প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র আমাদের জাহাজের প্রপেলারে আঘাত করে। ১০ মিনিট পর আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্র জাহাজের ইঞ্জিন কক্ষের ফুয়েল ট্যাংকে আঘাত করে, যার ফলে ভয়াবহ আগুন লেগে বিস্ফোরণ ঘটে।’’

প্রথম বিস্ফোরণের পরই জাহাজের ক্যাপ্টেন তুরস্কের কোস্ট গার্ড-এর সাথে যোগাযোগ করে সাহায্য প্রার্থনা করেন। ২ ঘণ্টা পর কোস্ট গার্ডের সদস্যরা তাদের উদ্ধার করে ইজমিত শহরে নিয়ে যান।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া বাংলাদেশের নাবিকের সাক্ষাৎকার

এ ঘটনায় উচ্ছ্বসিত, কিন্তু মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বাংলাদেশি নাবিক মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘‘এ ধরনের হামলার পর সবাই কিছুটা শঙ্কিত থাকে। যখন মিসাইল আক্রমণ করেছিল, তখন মনে হচ্ছিলো পৃথিবীটাই যেন শেষ হয়ে যাচ্ছে। তবে আল্লাহর রহমতে আমরা সুস্থ আছি, কিন্তু ভয় এখনো আমাদের মনের মধ্যে রয়েছে।’’

তিনি আরও বলেন, ‘‘বিশ্বাসই হচ্ছিল না, কীভাবে আমরা বেঁচে গেলাম। শুধু মনে হচ্ছিল পরিবারের কথা।’’ মাহফুজুল ইসলাম জানান, তার সঙ্গীরা সবাই একত্রে ছিলেন এবং তাঁরা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, কিছু না কিছু উপায় বের হবে।

জাহাজটি ছিল রাশিয়ার ‘ছায়া বহর’

এমটি কায়রোস জাহাজটি যদিও চীনা মালিকানাধীন, তবে এটি রাশিয়ার তেল বহরের একটি অংশ হিসেবে কাজ করছিল। রাশিয়া থেকে ক্রুড অয়েল পরিবহন করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলিতে পৌঁছানোর জন্য এই জাহাজটি ব্যবহার করা হত। তবে, ইউক্রেইন এবং তার সমর্থক দেশগুলো মেনে নিয়েছে যে, এই জাহাজগুলি রাশিয়ার যুদ্ধে অর্থায়ন করছে, যা বর্তমানে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে চলমান।

ইউক্রেইনের ড্রোন বোট থেকে ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণটি ছিল একটি যুদ্ধকালীন পদক্ষেপ, যা আন্তর্জাতিক আইনের বিরুদ্ধে ছিল বলে ইউক্রেইন দাবি করেছে। রাশিয়া অবশ্য এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি, তবে সূত্রমতে তারা এই হামলাকে 'আইনসিদ্ধ' বলেই মনে করে।

মিসাইল হামলার প্রভাব: আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ

ইউক্রেইনের সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বিশ্ব সম্প্রদায়কে তেল বহরের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে। তারা এই জাহাজগুলোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির জন্য আন্তর্জাতিক মহলের প্রতি দাবি জানিয়েছে, যাতে রাশিয়ার তেল রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায় এবং যুদ্ধের অর্থায়ন কমে যায়।

তবে, ইউক্রেইনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষিতে রাশিয়ার ক্রুড অয়েল পরিবহনে ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। যদিও রাশিয়া এটিকে বাণিজ্যিক সুরক্ষা বলে দাবি করে এসেছে, কিন্তু এই হামলা আন্তর্জাতিক জলবাণিজ্যে এক নতুন বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে।

বাংলাদেশি নাবিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ

তুরস্কের কোস্ট গার্ড এবং বাংলাদেশ নেভাল অ্যাকাডেমি অবশ্য নাবিকদের সুস্থতার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাখাওয়াত হোসেন জানিয়েছেন, ‘‘আমরা বাংলাদেশি নাবিকদের নিয়মিত খোঁজ রাখছি। তাদের যে কোনও প্রয়োজনে সাহায্য করা হবে।’’

তবে, এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার বা বাংলাদেশ দূতাবাস-এর পক্ষ থেকে তুরস্কে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাবিকদের সম্পর্কে কোনো সরাসরি যোগাযোগ করা হয়নি।

শেষ কথা

এমটি কায়রোসের উপর হামলার ঘটনা শুধু বাংলাদেশি নাবিকদের জন্য একটি বিপর্যয় ছিল না, এটি আন্তর্জাতিক জলপথের জন্যও একটি অশনিসংকেত। এমন হামলা এবং এর ফলস্বরূপ যে ধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব নাবিকদের ওপর পড়েছে, তা দেখিয়ে দেয় যুদ্ধের অঙ্গীকার কতটা ভয়াবহ হতে পারে। এছাড়া, রাশিয়ার তেল পরিবহন ও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার বিষয়েও বৃহত্তর আলোচনা প্রয়োজন।

বাংলাদেশি নাবিকদের অবস্থা এখন সেরকম হলেও তারা এই আক্রমণের ভয়াবহতা এবং ঘোর কাটাতে সচেষ্ট রয়েছেন, তবে এক সময়ের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তাদের মানসিক অবস্থায় গভীর প্রভাব ফেলেছে।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

গিনি-বিসাউয়ে সামরিক হস্তক্ষেপ: প্রেসিডেন্ট ও নেতাদের আটক, নির্বাচনী পরিস্থিতি স্থগিত

তারেক রহমান দেশে ফিরতে পারছেন না কেন? দেশের বাইরে থাকা নেতার আসল সত্য!