বাংলাদেশে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের আশঙ্কা: দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ
বিশ্বব্যাপী ভূমিকম্পের কারণে বিপর্যয়ের চিত্রগুলো দিন দিন প্রকট হচ্ছে, আর এরই মধ্যে বাংলাদেশেও বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক অবস্থান এবং টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থল হিসেবে ভবিষ্যতে ভয়াবহ ভূমিকম্পের হুমকি অনেক বেশি। বিশেষ করে, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় থাকা ‘মেগাথার্স্ট’ ফল্ট থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন দেশি ও বিদেশি বিশেষজ্ঞরা।
বিষয়টি কেন উদ্বেগজনক?
বাংলাদেশ ভূমিকম্পের জন্য একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের ঘটনা দেশের স্থাপত্য ও জনজীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। ২০২৪ সালের পর থেকে দেশের ভূমিকম্পের কম্পনের হার বেড়ে যাওয়ায় এই আশঙ্কা আরো বেশি প্রকট হয়েছে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৬ সালের একটি গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ‘মেগাথার্স্ট’ ফল্ট থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, সিলেট থেকে টেকনাফ পর্যন্ত যে সাবডাকশন জোন রয়েছে, সেখানে ৮০০-১০০০ বছর ধরে শক্তি জমা হতে থাকার কারণে এটি আগামীতে ভয়াবহ ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে। এই অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক অবস্থান এবং শক্তির সঞ্চয় মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে, যা বাংলাদেশের জন্য এক অনির্বাচিত বিপদ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সেমিনারে উদ্বেগ প্রকাশ
এ বিষয়ে সতর্কতা জানিয়ে জেসিএক্স ডেভেলপমেন্টস লিমিটেড আয়োজিত একটি সেমিনারে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে আয়োজিত ‘আর্থকুয়েক অ্যাওয়ারনেস, সেফটি প্রটোকল অ্যান্ড ইমার্জেন্সি প্রিপারেডনেস’ শীর্ষক এই সেমিনারে ভূমিকম্পের ঝুঁকি, সেফটি প্রটোকল, এবং জরুরি প্রস্তুতির ওপর আলোকপাত করা হয়। এতে অংশগ্রহণকারী বিশেষজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশ ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে, এবং সঠিক প্রস্তুতি না নিলে ভবিষ্যতে এটি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
ভূমিকম্পে প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তা
বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা, স্থপতি, প্রকৌশলী, রিয়েল এস্টেট উদ্যোক্তা, এবং নীতিনির্ধারকরা একমত যে, বাংলাদেশে ভূমিকম্প প্রতিরোধী ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সরকারের পাশাপাশি জনগণের সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। ঢাকার দ্রুত নগরায়ন, ঘনবসতি, বিল্ডিং কোডের অনুপালন এবং সংকীর্ণ সড়ক পরিস্থিতি ভূমিকম্পে বিপর্যয়ের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তুলছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, “অবিলম্বে ভূমিকম্প-সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণ, ভবনগুলোর স্ট্রাকচারাল অডিট, এবং জরুরি উদ্ধার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে”। এছাড়া, নাগরিকদের জন্য নিয়মিত ড্রিল এবং সচেতনতা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
জাপানি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
এই সেমিনারে জাপান থেকে আসা ভূমিকম্প-সহনশীল স্থাপত্য বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে ভূমিকম্পের জন্য নিরাপদ অবকাঠামো নকশা, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং টেকসই নির্মাণ কৌশল বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। তারা উল্লেখ করেন, ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় নকশা এবং প্রযুক্তি বাংলাদেশে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা উচিত।
কেসিরো সাকো এবং হেসাইয়ে সুগিয়ামা বলেন, “যত বেশি শক্তিশালী অবকাঠামো তৈরি করা যাবে, তত কম ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে”। তাদের মতে, ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার কাজের দক্ষতা এবং প্রাথমিক সতর্কবার্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রয়োজনীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের ভূমিকম্প ঝুঁকি এবং এর কারণ
বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিকভাবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে অবস্থিত। এখানে তিনটি সক্রিয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থল রয়েছে: ভারতীয়, মিয়ানমার এবং ইউরেশীয় প্লেট। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সিলেটের ডাউকি ফল্ট, চট্টগ্রাম-টেকনাফের চিটাগং-আরাকান ফল্ট, এবং মিয়ানমারের সাগাইং ফল্ট বাংলাদেশের ভূমিকম্পের জন্য অন্যতম প্রধান কারণ।
এছাড়া, দ্রুত নগরায়ন এবং ভবন নির্মাণে ত্রুটি ভূমিকম্পের সময় বিপর্যয়ের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। এই কারণে, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর যৌথ উদ্যোগে ভূমিকম্প প্রতিরোধী ব্যবস্থা গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।
নাগরিক সচেতনতা এবং ভবিষ্যত প্রস্তুতি
সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, “ভূমিকম্প-সহনশীল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ একমাত্র কার্যকর উপায়।” জনসচেতনতা বৃদ্ধি, এবং নাগরিকদের মাঝে জরুরি প্রস্তুতির জন্য তথ্যপ্রযুক্তি ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা প্রয়োজন।
বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার আহ্বান
ইকবাল হোসেন চৌধুরী, জেসিএক্স ডেভেলপমেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সেমিনারে বলেন, "ঢাকায় সম্প্রতি অনুভূত ভূমিকম্প বাংলাদেশের ভূমিকম্প ঝুঁকির বিষয়টি পুনরায় সামনে এনেছে। দ্রুত নগরায়ন, ঘনবসতি এবং দুর্বল ভবন কাঠামো বাংলাদেশের ভূমিকম্প প্রতিরোধ প্রস্তুতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”**
এমন পরিস্থিতিতে, রাষ্ট্র, আবাসন খাত, এবং জনগণের মধ্যে সমন্বয় থাকলে ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
উপসংহার:
ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়, কিন্তু যদি সঠিক প্রস্তুতি নেয়া হয়, তবে তার ক্ষতিকর প্রভাব অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ যদি এখনই সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, তবে ভবিষ্যতে এটি দেশের জন্য বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
