সিরিয়ায় ভয়াবহ সংঘর্ষে নতুন করে উত্তেজনা: ইসরাইলি হামলায় নারী–শিশুসহ প্রাণহানি, বাড়ছে উদ্বেগ
মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা আবারও নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে সিরিয়ার সর্বশেষ পরিস্থিতি ঘিরে। বেইত জিন্ন ও এর আশপাশের গ্রামীণ অঞ্চলগুলোতে ভোররাতে ইসরাইলি বাহিনীর অভিযানে অন্তত ১২ জন নিহত ও আরও বহু মানুষ আহত হওয়ার ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশুর উপস্থিতি এ হামলাকে আরও হৃদয়বিদারক করে তুলেছে। ইতোমধ্যে ঘটনাস্থলে উদ্ধারকারী দল কাজ শুরু করেছে, তবে ধ্বংসস্তূপে আটকে থাকা মানুষের কারণে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, সিরিয়ার সরকারি গণমাধ্যম ও স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে—ঘটনাটি ঘটে শুক্রবার ভোরে, যখন বেশ কয়েকটি ইসরাইলি ড্রোন বেইত জিন্ন অঞ্চলের আকাশে দীর্ঘক্ষণ টহল দিতে থাকে এবং একই সময়ে স্থল ও আকাশপথে হামলা পরিচালনা করা হয়। হামলার ফলে আবাসিক এলাকাগুলোতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে এবং বহু পরিবার নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়।
ইসরাইলের দাবি ও বিবৃতি
ইসরাইলি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এ অভিযানের সময় তাদের ছয় জন সেনাসদস্য আহত হয়েছে, যাদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। সেনাবাহিনীর দাবি, তারা ‘আল-জামা ইসলামিয়া’ নামে একটি সংগঠনের সক্রিয় সদস্যদের লক্ষ্য করে অভিযান পরিচালনা করেছিল। সংগঠনটির সদস্যরা দক্ষিণ সিরিয়ার বেইত জিন্ন অঞ্চলকে কেন্দ্র করে নাকি ইসরাইলি নাগরিকদের বিরুদ্ধে হামলার পরিকল্পনা করছিল—এমন অভিযোগ ইসরাইলি বাহিনীর তরফ থেকে উত্থাপন করা হয়েছে।
যদিও সিরিয়ার সরকারি পক্ষ এখনও পর্যন্ত এই অভিযোগ বা হামলার উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেনি। তাদের অবস্থান স্পষ্ট না হওয়ায় আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারছেন না।
সংঘর্ষের আগে কী ঘটেছিল?
স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানা গেছে, এর আগের দিন ইসরাইলি একটি টহলদল রাজধানী দামেস্কের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। সংঘর্ষ ঘনীভূত হলে ইসরাইলি দলটি পিছিয়ে যায়। পরদিনই সেই একই অঞ্চলে নতুন করে ইসরাইলি অভিযান পরিচালনা করা হয়। এতে ধারণা করা হচ্ছে, দুই ঘটনার মধ্যে কোনো না কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে।
ধ্বংসস্তূপে আটকে শ্বাসরুদ্ধ মানুষ
হামলার পরপরই বেইত জিন্নে উদ্ধারকারী দল, স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক এবং মানবিক সংগঠনগুলো মাঠে নামে। যেহেতু হামলা আবাসিক এলাকায় হয়েছে, তাই ধ্বংসস্তূপের নিচে বহু মানুষ আটকে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বেইত জিন্ন থেকে ইতোমধ্যে ডজন ডজন পরিবার নিরাপদ এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে, তবে অনেকে নিখোঁজ বলে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।
উদ্ধারকারী দলের একজন সদস্য বলেন—
“পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। অনেক ঘরবাড়ি ধসে পড়েছে। আমরা এখনও ধ্বংসস্তূপ থেকে ছোট শিশু এবং বৃদ্ধদের বের করতে চেষ্টা করছি।”
ইসরাইলের টানা অভিযান: অঞ্চলে বাড়ছে উত্তেজনা
ইসরাইলি নিরাপত্তা সংস্থাগুলো থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি নভেম্বরেই দক্ষিণ সিরিয়ায় অন্তত ৪৭টি অভিযান পরিচালনা করেছে ইসরাইল। শুধু তাই নয়—২০২৪ সালের ডিসেম্বরের পর থেকে সিরিয়ার ভেতরে ১,০০০-এর বেশি বিমান হামলা ও প্রায় ৪০০-এর মতো সীমান্ত অতিক্রমকারী বিশেষ অভিযান চালানো হয়েছে।
এই ধারাবাহিক অভিযান সিরিয়া–ইসরাইল সীমান্ত পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। গোলান মালভূমির নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নেও দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা চরমে। ২০২৪ সালের শেষ দিকে বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের পর ওই অঞ্চলে নতুন করে শক্তির ভারসাম্য বদলে গেছে। ইসরাইল বাফার জোনের একটি বড় অংশ দখলে নিয়ে নিজের অবস্থান আরও শক্ত করেছে, যা ১৯৭৪ সালের সিরিয়া–ইসরাইল বিচ্ছিন্নতা চুক্তির সরাসরি লঙ্ঘন বলে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করছেন।
আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন সিরিয়ার এই হামলাকে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে। বিশেষ করে বেসামরিক মানুষের মৃত্যু, নারী ও শিশুর প্রাণহানি এবং জনবহুল এলাকায় অভিযানের ঘটনায় আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠছে। সিরিয়ার সাধারণ নাগরিকদের জীবনযাত্রা এমনিতেই গৃহযুদ্ধ, অর্থনৈতিক সংকট ও খাদ্যঘাটতির কারণে চরম বিপর্যস্ত। তার ওপর নতুন করে এ ধরনের সামরিক হামলা মানবিক পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তুলতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্য–বিশেষজ্ঞরা মনে করেন—
“সিরিয়া এখন বহু শক্তির ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিটি পক্ষ নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী অভিযান পরিচালনা করতে চাইছে, আর এর মূল চাপ পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর।”
অঞ্চল ছাড়ছে পরিবারগুলো
হামলার পর বেইত জিন্ন ও মাযরাত বেইত জিন্ন অঞ্চলের বহু পরিবার এলাকা ছেড়ে পাশের তুলনামূলক নিরাপদ অঞ্চলে আশ্রয় নিচ্ছে। স্থানীয় শরণার্থী শিবিরগুলোতে নতুন ভিড় তৈরি হয়েছে। বয়স্ক, নারী ও শিশুরাই সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন। খাবার, পানি, চিকিৎসাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
সিরিয়ার মানবিক সংগঠনগুলো জানিয়েছে—
“যুদ্ধবিধ্বস্ত এই অঞ্চলে মানবিক সহায়তা পৌঁছানো কঠিন হচ্ছে। টানা হামলা ও সংঘর্ষের কারণে অনেক সড়ক চলাচলের অনুপযোগী।”
অর্থনীতি ও রাজনৈতিক বাস্তবতার দিক থেকে প্রভাব
ইসরাইল–সিরিয়া উত্তেজনা শুধু মানুষের প্রাণহানি ঘটাচ্ছে না; বরং দুই দেশের অর্থনীতি, রাজনৈতিক উত্তাপ, রাস্তাঘাট, সীমান্ত নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্কেও এর প্রভাব পড়ছে। সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ যুদ্ধপরবর্তী পুনর্গঠন অনেক বছর ধরে থমকেই রয়েছে। নতুন হামলাগুলো পরিস্থিতিকে আরও অনিশ্চিত করে তুলছে।
ইসরাইলের পক্ষেও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও সীমান্ত টহল বাড়ানোর ফলে ব্যয় বাড়ছে, এবং রাজনৈতিক চাপও বাড়ছে। মধ্যপ্রাচ্যের আরও দেশ, বিশেষ করে লেবানন, ইরান ও তুরস্ক এই পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
উদ্ধারের অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি
এমুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো উদ্ধার কার্যক্রম—কতজনকে জীবিত বের করা সম্ভব হবে, কতজন এখনো নিখোঁজ, এবং ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র কী তা জানা। এখনো অনেক ঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ায় উদ্ধারকারীরা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।
স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে—
“উদ্ধার অভিযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত চূড়ান্ত মৃত্যুর সংখ্যা জানানো সম্ভব নয়। আমরা সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছি।”
সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা—সহিংসতার ইতি চাই
সিরিয়ার নাগরিকরা দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ, হামলা, অপহরণ, আর্থিক সংকট—সবকিছু মিলিয়ে কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইলি হামলা তাদের নিরাপত্তাহীনতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রত্যাশা—আন্তর্জাতিক মহল এই ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা বন্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে এবং বেসামরিক মানুষের জীবনে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে আসবে।
উপসংহার
সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি আবারও ইঙ্গিত দিচ্ছে—মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি এখনো দুরাশা। ইসরাইলি বাহিনীর সাম্প্রতিক অভিযান, বেসামরিক প্রাণহানি এবং সীমান্ত উত্তেজনা এ অঞ্চলকে আরও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মানবিক সংকটের পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতাও এখানে গভীর প্রভাব ফেলছে। সামনে কী ঘটবে—তা এখনো অনিশ্চিত; তবে পরিস্থিতি আন্তর্জাতিকভাবে গভীর নজরদারির দাবিদার।
