বাউলশিল্পী আবুল সরকারের বিতর্কিত মন্তব্যকে ঘিরে শিল্পী সমাজে প্রতিক্রিয়া: ভিডিওবার্তায় কথা বললেন সংগীতশিল্পী সালমা
গরিক এবং শিল্পী সমাজ—সবমিলিয়ে দেশের বিভিন্ন মহল এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় লোকসংগীতশিল্পী মৌসুমী আক্তার সালমা একটি ভিডিওবার্তায় শিল্পীদের দায়িত্বশীল আচরণের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন, যা নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
অভিযোগ ও গ্রেপ্তার–সংক্রান্ত তথ্য
ঘটনার সূত্রপাত ৪ নভেম্বর মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জাবরা এলাকায় আয়োজিত একটি পালাগানের অনুষ্ঠানে। অভিযোগ রয়েছে, সেখানে আবুল সরকার তার পরিবেশনার এক পর্যায়ে ধর্মীয়ভাবে সংবেদনশীল কিছু মন্তব্য করেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত বেশ কয়েকজন ব্যক্তি বিষয়টি লক্ষ্য করেন এবং পরে ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর বিষয়টি নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা শুরু হয় এবং স্থানীয়ভাবে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।
পরদিন ৫ নভেম্বর রাতে মাদারীপুরের একটি অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করার সময় মানিকগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল তাকে আটক করে। পরদিন সকালে তাঁকে মানিকগঞ্জ জেলা ডিবি কার্যালয়ে আনা হয়। দুপুরে ঘিওর থানায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে আদালতের মাধ্যমে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, তদন্ত অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিতর্ককে ঘিরে সামাজিক প্রতিক্রিয়া
এ ধরনের অভিযোগ উত্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে দেশে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। অনেকেই সামাজিকমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ধর্মীয় সংবেদনশীলতার প্রশ্নে কোনো ধরনের মন্তব্য বা ব্যঙ্গকে তারা মেনে নিতে নারাজ বলে জানান। অন্যদিকে কিছু নাগরিক মনে করেন, যে কোনো অভিযোগ আইনের মাধ্যমে পর্যালোচনা হওয়া উচিত, এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় না গিয়ে সহিংস প্রতিক্রিয়া গ্রহণযোগ্য নয়।
এ ঘটনার পর মানিকগঞ্জের কিছু এলাকায় বাউল সম্প্রদায়ের কয়েকজন সদস্য হামলার শিকার হওয়ায় বিষয়টি আরও জটিল আকার ধারণ করে। অনেকেই মনে করেন, ব্যক্তিগত মন্তব্যের দায় পুরো সম্প্রদায়ের ওপর বর্তানো উচিত নয়।
শিল্পীদের দায়–দায়িত্ব নিয়ে সালমার বক্তব্য
ঘটনাটি নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছেন দেশের জনপ্রিয় লোকসংগীতশিল্পী মৌসুমী আক্তার সালমা। তিনি এক ভিডিওবার্তায় বলেন যে, একজন শিল্পীর দায়িত্বশীল আচরণ সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তিনি স্পষ্টভাবে জানান, শিল্পী সমাজকে সম্মান ধরে রাখতে হলে তাদের আচরণে সতর্কতা জরুরি।
তার বক্তব্যে তিনি বলেন,
“যারা বাউল শিল্পী আছেন, আপনারা গান করেন। কিন্তু এমন কিছু করবেন না যেটার জন্য পুরো শিল্পী সমাজ লজ্জিত হয়। প্রভুকে নিয়ে টানাটানি করবেন না। এটা আমাদের হৃদয়ে লাগে, বুকে আঘাত লাগে।”
তিনি আরও যোগ করেন,
“মা-বাবাকে কেউ গালি দিলে যেমন কষ্ট হয়, ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যও মানুষের অনুভূতিতে আঘাত দেয়। সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে কিছু বলা হলে মানুষ নিশ্চুপ থাকবে না—এটাই স্বাভাবিক।”
সালমার বক্তব্যের মূল সুর ছিল—শিল্পীর স্বাধীনতা থাকলেও দায়িত্ববোধ থাকা প্রয়োজন, কারণ তাঁদের কথার প্রভাব সাধারণ মানুষের আবেগ ও সামাজিক সম্প্রীতির ওপর পড়ে।
বাউল সম্প্রদায়কে সমালোচনা নয়, দায়িত্ববোধের আহ্বান
সালমা বলেন, একজন বাউল বা সাধক কখনও কাউকে কষ্ট দেওয়ার শিক্ষা দেন না। বাউলধারার মূল চেতনাই মানুষের প্রতি উদারতা ও সহনশীলতা। তাই তিনি মনে করেন, কোনোরূপ মঞ্চে বা ভিডিওতে এমন মন্তব্য করা উচিত নয় যা ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করতে পারে।
তিনি বলেন,
“অনেক সময় কথা বলতে গিয়ে ভুল হয়। কিন্তু ভিডিওটি দেখে মনে হলো না তিনি ভুল করে বলেছেন; বরং ভেবেচিন্তে বলেছেন। এমন বিষয় নিয়ে কৌতুক করা ঠিক নয়।”
তার এই বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকেই সালমার বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন, আবার কেউ কেউ মনে করছেন—অভিযোগ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে কঠোর মন্তব্য করা উচিত নয়। তবে সালমার বক্তব্যে তিনি কোথাও ব্যক্তিগত আক্রমণ বা ঘৃণার ভাষা ব্যবহার করেননি; বরং সবসময়ই দায়িত্বশীল আচরণের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
শিল্পী সমাজের অবস্থান
দেশের সংগীত অঙ্গনে কাজ করা অনেকেই মনে করছেন, শিল্পীরা সমাজের মানুষের কাছে পরিচিত মুখ; তাই তাঁদের কথাবার্তা নিয়ে সচেতন থাকা জরুরি। শিল্পীদের একটি অংশ মনে করেন, ধর্মীয় বিষয়ে মন্তব্যের আগে শিল্পীদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত, কারণ এসব বিষয় অত্যন্ত সংবেদনশীল।
অপরদিকে, কিছু শিল্পী মনে করেন, শিল্পীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে, তবে সেই স্বাধীনতাকে অপব্যবহার করা যাবে না। তারা বলেন, যে কোনো অভিযোগ অবশ্যই আইনের মাধ্যমে বিচার করা উচিত, এবং সামাজিক উত্তেজনা বা সহিংসতা সৃষ্টি করা কারও পক্ষেই দায়িত্বশীল আচরণ নয়।
আইনি প্রক্রিয়া ও অনুসন্ধান
মামলার বাদী ঘিওর উপজেলার একজন নাগরিক, যিনি অভিযোগ করেছেন যে আবুল সরকার তার বক্তব্যে ধর্মীয় মূল্যবোধকে আঘাত করেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, ভিডিও ফুটেজসহ সব তথ্য-উপাত্ত যাচাই করা হচ্ছে। তদন্তের ভিত্তিতে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। স্থানীয় প্রশাসন পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে নজরদারি বাড়িয়েছে।
বিতর্কের সামাজিক–সাংস্কৃতিক প্রভাব
বাউল সংগীত বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ সম্প্রদায় সাধারণত মানবপ্রেম, সহনশীলতা এবং আধ্যাত্মিকতার বার্তা প্রচার করে। তাই কোনো একজন ব্যক্তির মন্তব্যের কারণে পুরো সম্প্রদায়কে দায়ী করা হলে তা সাংস্কৃতিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।
এছাড়া, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে এমন কোনো বক্তব্য দেশে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। তাই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে আলোচনা বা পরিবেশনায় শিল্পীদের সতর্কতা প্রয়োজন।
উপসংহার
আবুল সরকারকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া বিতর্ক শুধু আইনগত বা সামাজিক প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি শিল্পীদের আচরণ, দায়িত্ববোধ এবং শিল্পী সমাজের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। সংগীতশিল্পী সালমার ভিডিওবার্তা সেই আলোচনাকে আরও গতিশীল করেছে, যেখানে তিনি শিল্পীদের সামনে দায়িত্বশীল আচরণের একটি পথ নির্দেশ করেছেন।
বর্তমানে মামলার তদন্ত চলছে, এবং আইনি প্রক্রিয়া অনুসারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে যে বিষয়টি স্পষ্ট—সমাজে শান্তি, পারস্পরিক সম্মান ও সংবেদনশীলতা বজায় রাখা সকলেরই দায়িত্ব। শিল্পীরা সমাজের প্রভাবশালী অংশ হওয়ায় তাদের কথাবার্তা ও আচরণ ব্যাপকভাবে মানুষকে প্রভাবিত করে।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে শিল্পী সমাজ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সাধারণ মানুষের সামনে আবারও নতুন করে প্রশ্ন উঠে এসেছে—সংস্কৃতি, মত প্রকাশ ও ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি সম্মান—এই তিনটির সমন্বয় কীভাবে রক্ষা করা যায়?
