সীমান্তে ৩০ হাজার টন পেঁয়াজের সংকট: রপ্তানি বন্ধে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের দুঃশ্চিন্তা চরমে


ভারত–বাংলাদেশ বাণিজ্যের ইতিহাসে অনেক ওঠানামা থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ের চেয়ে এমন বিপর্যয় আগে দেখা যায়নি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের বাজার সুরক্ষায় ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি সাময়িকভাবে সীমিত করায় পশ্চিমবঙ্গ ও মহারাষ্ট্রের একাধিক অঞ্চলে রপ্তানির উদ্দেশ্যে মজুদ করা বিশাল পরিমাণ পেঁয়াজ এখন সীমান্তেই পচে যাচ্ছে। পরিস্থিতি এমনভাবে চরমে উঠেছে যে ব্যবসায়ীরা পানির দরে, অর্থাৎ মাত্র ২ রুপিতে কেজি, পেঁয়াজ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।

ভারতের বিভিন্ন সীমান্ত ঘাট—**ঘোজাডাঙ্গা, পেট্রাপোল, মাহাদিপুর ও হিলি—**এ মুহূর্তে ট্রাক, গুদাম ও খোলা মাঠে পড়ে আছে কমপক্ষে ৩০ হাজার টনেরও বেশি পেঁয়াজ। রপ্তানিকৃত হলে এসব পেঁয়াজের বাজারমূল্য দাঁড়াত কোটি কোটি রুপি। অথচ এখন তা দিনের পর দিন নষ্ট হয়ে ব্যবসায়ীদের মাথাব্যথা আরও বাড়িয়ে তুলছে।

বাংলাদেশের সিদ্ধান্তের প্রভাব সরাসরি রপ্তানিতে

বাংলাদেশ সরকার স্থানীয় কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে হঠাৎ করেই ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ করে। নোটিশ জারি হওয়ার পর থেকে ভারতীয় রপ্তানিকারকরা আর কোনো নতুন পেঁয়াজ সীমান্ত পয়েন্টে প্রবেশ করাতে পারেননি। যদিও সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের ভারসাম্য রক্ষায় নেওয়া হয়েছে, ভারতীয় ব্যবসায়ীদের মতে একে "হঠাৎ সিদ্ধান্ত" বলেই বিপর্যয় প্রকট হয়েছে।

রপ্তানিকারকদের অভিযোগ—বাংলাদেশের কয়েকজন আমদানিকারক মৌখিকভাবে তাদের আশ্বস্ত করেছিলেন যে বড় পরিমাণ পেঁয়াজ পাঠালে তা গ্রহণ করা হবে। সেই আশ্বাসকে ভিত্তি করেই নাসিক, ইন্দোরসহ বিভিন্ন উৎপাদন অঞ্চলের পাইকাররা বড় ট্রাকভর্তি পেঁয়াজ সীমান্তে এনে মজুদ করেন। দিন পেরোতেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়।

খরচ ২২ রুপি, বিক্রি মাত্র ২ রুপিতে

পেঁয়াজের প্রধান উৎপাদন অঞ্চল নাসিক থেকে সীমান্ত জোনে পেঁয়াজ আনতে পরিবহন, লোডিং-আনলোডিং, শ্রমিক মজুরি এবং অন্যান্য ব্যয় মিলিয়ে প্রতি কেজিতে ব্যবসায়ীদের খরচ হয়েছে ২২ রুপির মতো। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পেঁয়াজ বাংলাদেশে রপ্তানি হলে তারা ৩০–৩২ রুপিতে বিক্রি করতে পারতেন, যেখানে প্রতি কেজিতে মিলত ৮–১০ রুপির স্থায়ী লাভ।

কিন্তু রপ্তানি বন্ধ হতেই কয়েকদিনের মধ্যেই লাখ লাখ টাকার ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় ট্রাকভর্তি নষ্ট হওয়া মজুদ। ফলস্বরূপ ব্যবসায়ীরা শুরু করেন লোকসান ঠেকানোর দৌড়ঝাঁপ। অনেকেই ২ রুপি, কোনও কোনও ক্ষেত্রে ৬–১০ রুপি দরে পেঁয়াজ বেচে দিচ্ছেন।

মাহাদিপুর-সোনামসজিদ সীমান্ত এলাকায় ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১০০ রুপিতে—যা শুনে স্থানীয় বাজারের ক্রেতারাও বিস্মিত। কারণ দূরত্ব মাত্র ৭ কিলোমিটার হলেও মালদহ শহরের বাজারে একই সময় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২০–২২ রুপিতে।

ব্যবসায়ীদের কণ্ঠে ক্ষোভ ও অসহায়তা

মালদহ জেলার ব্যবসায়ী সাজিরুল শেখ দীর্ঘদিন ধরেই পেঁয়াজ রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত। তার ভাষায়,

“আমরা কেউ ৫০ ট্রাক, কেউ ৭০ ট্রাক পেঁয়াজ নিয়ে এসেছিলাম। বাংলাদেশের বাজারে সাধারণত এই সময় চাহিদা খুব বেশি থাকে। হঠাৎ রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় সব পেঁয়াজ পচতে শুরু করেছে। এখন বাধ্য হয়ে অল্প দামে বিক্রি দিচ্ছি।”

একইভাবে অপর ব্যবসায়ী জাকিরুল ইসলাম জানান যে, তিনি গত দুই মাসে নিয়মিত ৩০–৩৫ ট্রাক পেঁয়াজ রপ্তানি করতেন। কিন্তু সীমান্ত বন্ধের পর গুদামে থাকা পেঁয়াজ দ্রুত নষ্ট হতে থাকে। ফলে তিনি দিনমজুর বহর বাড়িয়ে ভালো-খারাপ পেঁয়াজ আলাদা করছেন এবং যা দাম পাওয়া যায়, সেটাতেই বিক্রি করছেন।

তাদের মতে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

স্থানীয় ভারতীয় বাজারে দ্বৈত পরিস্থিতি

পেঁয়াজের এই অস্বাভাবিক অবমূল্যায়ন দেখে অনেকে ভেবে নিতে পারেন যে স্থানীয় বাজার এখন স্বস্তিতে। কিন্তু বাস্তবে দৃশ্যপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। মালদহ, দিনাজপুর, নদিয়া সহ বিভিন্ন জেলার স্থানীয় বাজারে পেঁয়াজের দাম ২০–৩০ রুপির মধ্যে ওঠানামা করছে। অর্থাৎ যেখানে ভোক্তারা বাজারে তুলনামূলক বেশি দামে পেঁয়াজ কিনছেন, সেখানে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরেই ট্রাকে-ট্রাকে পড়ে থাকা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে পানির দরে।

স্থানীয় ক্রেতা খাইরুল হকের কথায়—

“ব্যবসায়ীরা যে ক্ষতির মুখে পড়ছেন, তা দেখে খুশি হওয়ার কিছু নেই। রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনার অভাবে যে পেঁয়াজ ২০–৩০ রুপিতে কিনছি, তা সীমান্তে ২ রুপি দরে বিক্রি হচ্ছে—এটা খুবই অস্বাভাবিক।”

রপ্তানির এই ধাক্কা কি দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে?

বাণিজ্য বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারত–বাংলাদেশ পেঁয়াজ বাণিজ্য বহু বছর ধরে পারস্পরিক উপকারে চলছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার বড় অংশই আসে ভারতের সরবরাহ থেকে, আবার ভারতের পেঁয়াজ উৎপাদনকারী রাজ্যগুলো বাংলাদেশ বাজারকে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য বলে মনে করে।

কিন্তু বারবার আমদানি-রপ্তানি বন্ধ-খোলা পরিস্থিতি ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে তুলছে। এতে ভবিষ্যতে রপ্তানিকারকরা বড় বিনিয়োগে অনীহা প্রকাশ করতে পারেন। এর নেতিবাচক প্রভাব উভয় দেশের বাজারেই পড়তে পারে।

ক্ষতি কমাতে রপ্তানিকারকদের জরুরি উদ্যোগ

পেঁয়াজ দ্রুত নষ্ট হওয়া পণ্য হওয়ায় ব্যবসায়ীরা প্রতি মুহূর্তে ক্ষতির আশঙ্কায় থাকেন। তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে তারা কয়েকটি পদক্ষেপ নিচ্ছেন—

  1. বেশি শ্রমিক নিয়োগ করে পেঁয়াজ বাছাই

  2. লোকাল পাইকারী মার্কেটে কম দামে বিক্রি

  3. মুঠোফোনে বিভিন্ন হোলসেলারকে যোগাযোগ করে বেঁচে যাওয়া পেঁয়াজ দ্রুত সরবরাহ

  4. কোল্ড স্টোরেজে অল্প পরিমাণ সংরক্ষণ, যদিও অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে

তাদের মতে, যতোই কম দামে হোক—বিক্রি করতেই হবে, নইলে প্রতিদিন ক্ষতির অঙ্ক বেড়েই চলবে।

বাংলাদেশের বাজারে কী প্রভাব পড়তে পারে?

বাংলাদেশে সাধারণত নভেম্বর–ডিসেম্বর সময়ে পেঁয়াজের দাম কিছুটা বাড়তে দেখা যায়। বর্তমানে স্থানীয় বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজ প্রবেশ সীমিত হওয়ায় দাম কিছুটা বেড়ে প্রতি কেজি ৯০–১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তবে বাংলাদেশ সরকার দেশীয় কৃষকের উৎপাদন বাজারে ওঠার আগ পর্যন্ত আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। ফলে দামের ওপর চাপ থাকলেও বাজার শিগগিরই স্থিতিশীল হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।

এই পরিস্থিতির সম্ভাব্য সমাধান কী?

বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি প্রস্তাব রেখেছেন—

  • ভারত–বাংলাদেশের মধ্যে স্থায়ী আমদানি-রপ্তানি নীতিমালা তৈরি

  • বাংলাদেশে ইমপোর্ট পারমিট প্রক্রিয়া স্পষ্ট ও পূর্ব ঘোষণা করা

  • সীমান্তে বড় আকারে পণ্যমজুদ হলে যৌথ পর্যবেক্ষণ দলের হস্তক্ষেপ

  • ভারতীয় উৎপাদন অঞ্চলে রপ্তানিকারক–ব্যবসায়ীদের জন্য ক্ষতিপূরণ বা স্বল্প সুদের ঋণ সহায়তা

শেষ কথা

সীমান্তে আটকে থাকা ৩০ হাজার টন পেঁয়াজ শুধু ব্যবসায়ীদের ক্ষতির প্রতীক নয়—এটি দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক, নীতিমালা পরিকল্পনা এবং কৃষিপণ্য ব্যবস্থাপনার একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন। দ্রুত সিদ্ধান্ত না হলে ক্ষতির অঙ্ক আরও বাড়বে এবং এর প্রভাব দীর্ঘ মেয়াদে উভয় দেশের বাজারেই দেখা দিতে পারে।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

গিনি-বিসাউয়ে সামরিক হস্তক্ষেপ: প্রেসিডেন্ট ও নেতাদের আটক, নির্বাচনী পরিস্থিতি স্থগিত

এমটি কায়রোসে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা: কেমন আছেন বাংলাদেশি নাবিকরা?

তারেক রহমান দেশে ফিরতে পারছেন না কেন? দেশের বাইরে থাকা নেতার আসল সত্য!