রাশিয়া–ইউক্রেন উত্তেজনা, জাপানকে হুঁশিয়ারিসহ —এক দিনে তিনটি বড় বার্তা দিল মস্কো
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাশিয়ার অবস্থান, কূটনৈতিক টানাপোড়েন, সামরিক পরিস্থিতি ও নতুন আঞ্চলিক জোট—এসবকে ঘিরে বিশ্ব রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এরই মধ্যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন, যা বিশ্বমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। পুতিনের বক্তব্যে উঠে এসেছে ইউক্রেন যুদ্ধের সামরিক হিসাব, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ইস্যু এবং ইউরোপকে ঘিরে তৈরি হওয়া নতুন আশঙ্কা। এছাড়া জাপানের সামরিক পরিকল্পনা নিয়ে রাশিয়ার কড়া প্রতিক্রিয়া এবং ইরানের সঙ্গে কৃষিখাতের সহযোগিতা বৃদ্ধির ইঙ্গিতও নতুন কূটনৈতিক বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত দেয়।
নভেম্বরের শেষভাগে কাজাখস্তানের রাজধানী বিশকেকে অনুষ্ঠিত সিএসটিও (Collective Security Treaty Organization) শীর্ষ সম্মেলনের অবকাশে পুতিন সাংবাদিকদের সামনে বিভিন্ন ইস্যুতে বিস্তারিত মন্তব্য করেন। পুতিনের বক্তব্যে এই অঞ্চলের নিরাপত্তা, ভূরাজনৈতিক চাপ এবং পশ্চিমা প্রভাবের বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে পুতিনের সমালোচনা
পুতিন যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞাকে মস্কো–ওয়াশিংটন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জন্য “ধ্বংসাত্মক” বলে উল্লেখ করেন। তার মতে, মার্কিন প্রশাসন রুশ কোম্পানি ও রাশিয়ার অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়াতে বিশেষভাবে সক্রিয়। তবে এই চাপ কেবল দুই দেশের সম্পর্ককেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, বরং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থাকেও অস্থিতিশীল করছে।
পুতিন বলেন, নিষেধাজ্ঞা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হলে তা বিশ্ব অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তবু তিনি অভিযোগ বা উত্তেজনা বাড়ানোর পরিবর্তে সম্ভাব্য কূটনৈতিক সমাধানের পথ রেখে দেন। বিশেষ করে তিনি জানান, ইউক্রেন সংকট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে নির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছে, তা ভবিষ্যতে সমঝোতার ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এই মন্তব্য আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
“রাশিয়া ইউরোপে হামলা করবে”—মিডিয়া প্রচারণা নিয়ে পুতিনের প্রতিক্রিয়া
সাম্প্রতিক সময়ে কিছু পশ্চিমা গণমাধ্যমে দাবি করা হচ্ছে যে রাশিয়া ইউরোপের ওপর সামরিক হামলার পরিকল্পনা করছে। তবে পুতিন এই ধারণাকে তিনি “পুরোপুরি মিথ্যা” ও “অর্থহীন আতঙ্ক সৃষ্টি” হিসেবে বর্ণনা করেন।
তার দাবি—এ ধরনের প্রচারণা সাধারণ জনগণকে ভয় দেখানোর জন্য করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ইউরোপে স্থিতি–সংকট তৈরি করে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর পথ তৈরি করাই এই প্রচারণার মূল উদ্দেশ্য হতে পারে।
রাশিয়া এই ধরনের আঞ্চলিক সংঘাতে আগ্রহী নয়—এ কথা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন পুতিন।
সিএসটিও–র সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে রাশিয়ার অস্ত্র কর্মসূচি
পুতিন জানান, রাশিয়া ইতোমধ্যে সিএসটিও সদস্য দেশগুলোর সামরিক সহযোগিতা শক্তিশালী করতে বড় ধরনের অস্ত্র কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মধ্য এশিয়ার স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই জোটের সামরিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
তার মতে, বহুপাক্ষিক নিরাপত্তা কাঠামো শক্তিশালী না হলে অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ঝুঁকির মুখে পড়বে। সিএসটিও—র সদস্যরা এই কর্মসূচিকে আঞ্চলিক নিরাপত্তা বাড়ানোর এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হিসেবে দেখছে।
এক মাসে ইউক্রেনের সাড়ে ৪৭ হাজার সেনা হতাহত—পুতিনের দাবি
সবচেয়ে আলোচিত বক্তব্যটি ছিল ইউক্রেন যুদ্ধসংক্রান্ত। পুতিন দাবি করেন, গত এক মাসে ইউক্রেনীয় বাহিনীর প্রায় ৪৭,৫০০ সেনা নিহত হয়েছে। যদিও স্বাধীনভাবে এই সংখ্যা যাচাই করা সম্ভব নয়, তবুও এটি আন্তর্জাতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ইউক্রেন যখন দখল করা অঞ্চলগুলো থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে, তখনই সংঘাতের সমাপ্তি ঘটবে। তার ভাষায়, “ইউক্রেনীয় বাহিনী পিছু হটলেই যুদ্ধ শেষ হবে।” অন্যথায় রাশিয়া সামরিক শক্তি ব্যবহার করে লক্ষ্য অর্জন করবে—এটাই তার সতর্ক বার্তা।
এই মন্তব্য কূটনৈতিকভাবে বহু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিমা মিত্রদের কাছ থেকে ইউক্রেন যে সামরিক সহায়তা পাচ্ছে, তার প্রেক্ষাপটে এই দাবি নতুন সমীকরণ তৈরি করছে।
তাইওয়ানের কাছে জাপানের ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন পরিকল্পনা—রাশিয়ার কঠোর হুঁশিয়ারি
রাশিয়া–জাপান সম্পর্ক গত কয়েক বছরে একাধিক ইস্যুতে উত্তেজনার মধ্য দিয়ে গেছে। এবার তাইওয়ানের নিকটবর্তী এলাকায় জাপানের ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের পরিকল্পনার বিষয়টি সেই উত্তেজনাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্পষ্ট ভাষায় জানায়, টোকিও এমন সিদ্ধান্ত নিলে মস্কো প্রয়োজনীয় প্রতিক্রিয়া দেখাতে “পূর্ণ অধিকার” রাখে। তাদের অভিযোগ—জাপান যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবে এ ধরণের সামরিক পদক্ষেপ নিচ্ছে, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে।
তাইওয়ান ইস্যু দীর্ঘদিন ধরেই এশিয়ার সবচেয়ে স্পর্শকাতর ভূরাজনৈতিক সমস্যা। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা যেখানে তাইওয়ানের সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে, সেখানে চীন এর বিরোধিতা করছে। রাশিয়ার সাম্প্রতিক মন্তব্য দেখায়—এই ইস্যুতে মস্কো বেইজিংয়ের অবস্থানের কাছাকাছি যাচ্ছে।
রাশিয়া–ইরান কৃষিসহযোগিতা: অর্থনৈতিক দিগন্ত উন্মোচন
সামরিক উত্তেজনার পাশাপাশি অর্থনীতি ও বাণিজ্যেও রাশিয়া নতুন অংশীদার খুঁজছে। সাম্প্রতিক বৈঠকে ইরান ও রাশিয়ার কৃষিমন্ত্রীরা দ্বিপক্ষীয় কৃষি সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে সম্মত হন। মস্কোয় অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে দুই মন্ত্রী কৃষিখাতে নতুন প্রকল্প, বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং উভয় দেশের খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেন।
রাশিয়ার কৃষিমন্ত্রী জানিয়েছেন, ইরান বর্তমানে কৃষি বাণিজ্যে রাশিয়ার অন্যতম প্রধান অংশীদার। চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে দুই দেশের কৃষি বাণিজ্য ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি দেখায়—রাশিয়া আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার চাপ মোকাবিলা করতে এশিয়া-মধ্যপ্রাচ্যের নতুন বাজারকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে।
এই সহযোগিতা শুধু খাদ্য উৎপাদনেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং কৃষি প্রযুক্তি, গবেষণা, খাদ্য রপ্তানি ও সেচব্যবস্থা উন্নয়নসহ আরও বহু ক্ষেত্রে বিস্তৃত হতে পারে।
বিশ্লেষণ: কী বুঝিয়ে দিল আজকের তিনটি বড় ঘোষণা?
সমগ্র ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে তিনটি বড় বিষয় স্পষ্ট—
১. রাশিয়া সামরিকভাবে আগ্রাসী অবস্থানে রয়েছে
ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাশিয়া স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে—তারা নিজেদের দাবি থেকে সরে দাঁড়াবে না।
২. মার্কিন প্রভাব প্রতিহত করতে রাশিয়া নতুন জোট গড়ছে
ইরানের সঙ্গে কৃষিসহযোগিতা, চীনের সঙ্গে কৌশলগত ঘনিষ্ঠতা—সব মিলিয়ে রাশিয়া পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করার বিকল্প পথ তৈরি করছে।
৩. এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নতুন সামরিক উত্তেজনা
জাপান–তাইওয়ান–রাশিয়া প্রেক্ষাপট ভবিষ্যতে বড় ধরনের আঞ্চলিক উত্তেজনার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
উপসংহার
রাশিয়ার সাম্প্রতিক বার্তাগুলো শুধু এক দেশের নীতিগত অবস্থান নয়; বরং বৈশ্বিক ক্ষমতার নতুন সমীকরণ তৈরি করছে। ইউক্রেন যুদ্ধ এখনো অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জাপানের ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন ইস্যু ও ইরানের সঙ্গে রাশিয়ার নতুন বাণিজ্য সহযোগিতা।
বিশ্ব রাজনীতি আগামী মাসগুলোতে ঠিক কোনপথে যাবে—তা এখনো অজানা, তবে প্রতিটি ঘোষণাই নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত করে।
