তাহাজ্জুদের নামাজরত অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল ১২ বছরের মাদরাসাছাত্র! কী ঘটেছিল?
নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার বিষ্ণুরামপুর নুরানী হাফিজিয়া মাদরাসায় একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে। ১২ বছরের মাদরাসা শিক্ষার্থী আকরাম হোসেন নামাজরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন, যা স্থানীয় এবং জাতীয় গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে।
ঘটনার বিস্তারিত:
শুক্রবার (২৮ নভেম্বর) দিবাগত রাত সাড়ে ৪টার দিকে, নোয়াখলা ইউনিয়নের বিষ্ণুরামপুর নুরানী হাফিজিয়া মাদরাসার হেফজ খানায় এক অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। আকরাম হোসেন প্রতিদিনের মতো সেই রাতেও তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করছিলেন। তাহাজ্জুদ নামাজে অংশগ্রহণ শেষে, হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে অন্য এক ছাত্রের কোলে ঢলে পড়েন। তৎক্ষণাৎ তার সহপাঠীরা তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন, তবে দুঃখজনকভাবে হাসপাতাল পৌঁছানোর আগেই আকরাম মারা যান।
মাদরাসা কর্তৃপক্ষের বক্তব্য:
এ বিষয়ে বিষ্ণুরামপুর নুরানী হাফিজিয়া মাদরাসার প্রধান শিক্ষক হাফেজ মহিন উদ্দিন জানিয়ে বলেন, আকরাম মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার পর থেকে কোরআন হেফজ সম্পন্ন করেন। তিনি ১৬ পারা কোরআন হেফজ করেছিলেন এবং তার নিয়মিত নামাজ ও দ্বীনি কার্যক্রমে ছিলেন অত্যন্ত মনোযোগী। শিক্ষক মহিন উদ্দিন আরও বলেন, শুক্রবার রাত সোয়া ৪টার দিকে আকরাম নামাজ পড়ছিলেন, তখন হঠাৎ করে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং দ্রুততার সাথে সহপাঠীরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান, কিন্তু তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
আকরামের পরিবার ও পরিচিতদের প্রতিক্রিয়া:
আকরাম হোসেন লক্ষীপুর জেলার কমলনগর উপজেলার ফারুক হোসেনের ছেলে এবং তিনি বিষ্ণুরামপুর নুরানী হাফিজিয়া মাদরাসার হেফজ বিভাগের ছাত্র ছিলেন। আকরামের মৃত্যুর পর তার পরিবার এবং এলাকাবাসী শোকের ছায়ায় ছেয়ে গেছে। স্থানীয়দের মধ্যে কেউ কেউ জানিয়েছেন, আকরাম ছিল একটি ভালো ছেলে, তার মধ্যে কোনো ধরনের শারীরিক অসুস্থতা আগে কখনও দেখা যায়নি। মাদরাসার শিক্ষকরা তাকে অত্যন্ত ভদ্র ও দায়িত্বশীল ছাত্র হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
শুক্রবার রাতে আকরামের মৃত্যুর পর, তার পরিবারের সদস্যরা দ্রুত মাদরাসায় উপস্থিত হন। জানাজার নামাজের পর আকরামের মরদেহ তার গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
মাদরাসা ও স্থানীয় প্রশাসনের অবস্থান:
নোয়াখালী জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে চাটখিল থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আব্দুস সুলতান জানিয়েছেন, আকরামের মৃত্যুর ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। তবে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন জানাচ্ছে, এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ বা সন্দেহ নেই। মৃতদেহের ময়নাতদন্তের প্রয়োজনীয়তা না থাকায় মৃতের পরিবার কোনো আইনি পদক্ষেপ নেননি।
পুলিশ পরিদর্শক আরও বলেন, “এটি একটি দুর্ঘটনাজনিত ঘটনা মনে হচ্ছে এবং মাদরাসা কর্তৃপক্ষ বা পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ তোলা হয়নি।”
আকরামের মৃত্যু: একটি গভীর শোক ও প্রশ্ন
এই ঘটনা স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক শোকের সৃষ্টি করেছে। মাদরাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আকরাম ছিল একজন উদাহরণস্বরূপ ছাত্র। তার মর্মান্তিক মৃত্যু অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছে। কেননা, নামাজের সময় মৃত্যুর ঘটনা সাধারণত খুবই বিরল, বিশেষত একজন এত তরুণ শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে।
এছাড়া, এই মৃত্যু অন্যান্য মাদরাসা শিক্ষার্থীদের পরিবারকে একটি বড় প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে—মাদরাসার ছাত্রদের জন্য যথাযথ চিকিৎসা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটুকু কার্যকর? আকরামের মৃত্যু কেবল তার পরিবারের জন্যই নয়, পুরো মাদরাসা সমাজের জন্য একটি বড় ক্ষতি, যা ভুলে যাওয়ার মতো নয়।
এমন পরিস্থিতির মোকাবেলা:
মাদরাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে এমন পরিস্থিতিতে মৃত্যু একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হলেও, এটি অনেক ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থার এক অংশ হিসেবেও দেখা যেতে পারে। মাদরাসা কর্তৃপক্ষের উচিত, শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আরো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ছাত্রদের নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা, সঠিক চিকিৎসা সেবা এবং কোনো ধরনের শারীরিক অস্বাস্থ্যবোধের পূর্বাভাস পাওয়ার পর জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষ করে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া উচিত। নামাজরত অবস্থায় আকরামের মৃত্যু প্রকৃতই একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা এবং এটি মাদরাসা প্রশাসন ও স্থানীয় প্রশাসনকে কিছু নতুন দিক চিন্তা করতে বাধ্য করেছে।
শেষ কথা:
আকরামের মৃত্যু একটি শোকাবহ ঘটনা, যা অনেকের হৃদয়কে স্পর্শ করেছে। তার পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে, আশা করা যাচ্ছে, এই ঘটনা দেশের অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একটি শিক্ষা হতে পারে, যাতে ভবিষ্যতে এমন মর্মান্তিক ঘটনা এড়ানো যায়। মৃত্যুর এই ঘটনা শুধু পরিবারের নয়, পুরো এলাকার জন্য একটি অম্লান দাগ হয়ে থাকবে, যা সহজে মুছে যাবে না।
