‘গরিব’ স্বামীর কোটিপতি স্ত্রী: চট্টগ্রামের দুই গৃহিণীর কোটি টাকার সম্পত্তি নিয়ে দুদকের রহস্য উন্মোচন!
চট্টগ্রামের দুই সাধারণ সরকারি কর্মচারীর আয়–রোজগার দেখে তাঁদের পরিবারকে অনেকেই সাধারণ মধ্যবিত্ত ভাবতেই পারেন। কিন্তু বাস্তব চিত্রটি একেবারে উল্টো। পুলিশ কনস্টেবল এবং সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের এক অফিস সহকারীর জীবনযাত্রা যেখানে সীমিত, সেখানে তাঁদের স্ত্রীদের নামে রয়েছে কোটি টাকার সম্পত্তি, বহুতল ভবন, দোকানপাট ও জমি। দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে—এই সম্পদের বিপরীতে কোনো বৈধ আয়ের উৎস খুঁজে পাওয়া যায়নি। বরং তাঁদের স্বামীদের দীর্ঘ চাকরিজীবনে অর্জিত জ্ঞাতআয়বহির্ভূত অর্থই স্ত্রীর নামে সম্পত্তি হিসেবে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
ঘটনাটি শুধু চমকে দেওয়ার নয়, বরং দেশের সরকারি চাকরিজীবী সমাজে অবৈধ সম্পদলুকানোর যেসব কৌশল প্রচলিত আছে, তার এক উন্মোচিত প্রতিচ্ছবি।
চট্টগ্রামের দুই দম্পতির গল্প: কাগজে ‘গরিব’, বাস্তবে কোটিপতি
দুই স্বামী—
১) পুলিশের সাবেক কনস্টেবল সেলিম হাওলাদার
২) সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের অফিস সহকারী মো. আলমগীর লাতু
দুই স্ত্রী—
জাহানারা বেগম (জিইসি মোড়–সংলগ্ন জাকির হোসেন বাই লেন)
হাসিনা বেগম (চট্টগ্রাম পাথরঘাটা ব্রিক ফিল্ড বাই লেন)
দুদক যখন তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে, তখন অবাক হয়ে যায় তদন্ত কর্মকর্তারা। কারণ—
-
স্বামীদের নামে প্রায় কোনো সম্পদ নেই, নেই উল্লেখযোগ্য আয়
-
স্ত্রীদের নামে রয়েছে কোটি টাকার বহুতল ভবন, জমি, দোকান, কলোনি
-
এমনকি দুই স্ত্রীই আয়করদাতা, কিন্তু তাঁদের স্বামীরা নন
এ থেকেই সন্দেহের সূত্রপাত এবং পরবর্তী তদন্তে বেরিয়ে আসে অবৈধ অর্থের লেনদেন, ভুয়া স্বর্ণ বিক্রির রসিদ, ভুয়া দোকান ও হেবামূল দেখানোর মতো বিভিন্ন প্রতারণার ঘটনা।
জাহানারা বেগম: কনস্টেবলের স্ত্রী কীভাবে সোয়া কোটি টাকার মালিক হলেন
জাহানারা বেগমের স্বামী সেলিম হাওলাদার ১৯৭৬ সালে কনস্টেবল পদে যোগ দেন এবং ২০১২ সালে অবসর নেন। বেতনভুক একটি সাধারণ চাকরি—যেখানে অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ সীমিত। অথচ তাঁর স্ত্রী জাহানারা বেগমের নামে এখন রয়েছে—
-
জিইসি মোড়সংলগ্ন ৬তলা ভবন
-
টিনশেড কলোনি
-
দোকানঘর
-
মোট সম্পদের মূল্য কাগজে ৮৫ লাখ ৫৭ হাজার টাকা
-
বাস্তব বাজারমূল্য ২০ কোটি টাকার বেশি
দুদকের তদন্তে কী বের হলো?
দুদক খুঁজে পেয়েছে—
-
তাঁর মোট সম্পদ ১ কোটি ৭১ লাখ ৯৮ হাজার টাকা
-
বৈধ আয় মাত্র ৫৯ লাখ ৬১ হাজার টাকা
-
অর্থাৎ ১ কোটি ১২ লাখ টাকার সম্পদ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত
কীভাবে এই সম্পদ ‘বৈধ’ দেখানো হয়েছিল?
-
ভুয়া স্বর্ণের দোকান দেখিয়ে ২০ লাখ টাকার স্বর্ণ বিক্রির কাগজপত্র বানানো
— যে দোকানটির নাম ‘কর জুয়েলার্স’—তার অস্তিত্বই নেই। -
‘হেবামূলে’ জমি পাওয়ার ভুয়া দাবি
— বোনের কাছ থেকে কেনা জমি দেখানো হয়েছে দান হিসেবে। -
৬.৩৫ কাঠা জমি মাত্র ৮ হাজার টাকায় কেনা দেখানো
— যা সম্পূর্ণ অবাস্তব। -
ছেলের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা উপহার দেখিয়ে আয় লুকানোর চেষ্টা।
দুদকের মন্তব্য
দুদক বলছে—
স্বামীর চাকরিজীবনের অবৈধ অর্থ স্ত্রী ব্যবহার করেছেন এবং কাগজে-কলমে নিজের নামে বৈধ সম্পদ হিসেবে দেখিয়েছেন।
জাহানারার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র ইতোমধ্যে আদালতে দাখিল হয়েছে।
হাসিনা বেগম: পিয়নের স্ত্রী হয়েও কোটি টাকার বাড়ির মালিক
অন্যদিকে আছেন হাসিনা বেগম। তাঁর স্বামী, অফিস সহকারী (পিয়ন) আলমগীর লাতুর বেতনের সীমিত আয়ে একটি পরিবারের চলাই কষ্টকর। অথচ তাঁর স্ত্রী—
-
২০০৭ সালে ২০ লাখ টাকায় পাথরঘাটায় তিন কড়া জমি কেনেন
-
সেখানে ৬তলা চার ইউনিট ভবন নির্মাণ
-
মোট ব্যয় দেখানো হয়েছে ৫৬ লাখ টাকা
-
কাগজে দেখানো স্থাবর–অস্থাবর সম্পদ ১ কোটি ১২ লাখ টাকা
দুদকের অনুসন্ধান
দুদক পায়—
-
বৈধ আয় সাড়ে ৪৬ লাখ টাকা
-
অবৈধ সম্পদ ৬৪ লাখ টাকার বেশি
তাঁর জমির প্রকৃত দাম কত ছিল?
স্থানীয়দের মতে—
-
পাথরঘাটায় ১ কড়া জমির মূল্য দীর্ঘদিন ধরেই দেড়–দুই কোটি টাকা
-
সুতরাং ৩ কড়া জমির মূল্য ছিল ৪–৫ কোটি টাকা
কিন্তু কাগজে দেখানো হয়েছে মাত্র ২০ লাখ টাকা—যা ঐ এলাকায় সম্পূর্ণ অবাস্তব।
সম্পদ বৈধ দেখাতে কী কৌশল?
-
বাবা–ভাইয়ের দান দেখিয়ে অর্থের উৎস লুকানো
-
স্বর্ণ উপহারের নামে কালো টাকা সাদা করার চেষ্টা
-
জমির মূল্য মৌজা অনুযায়ী কম দেখানো
দুদকের বক্তব্য: “স্বামীরা গরিব, স্ত্রী কোটিপতি—এটা স্বাভাবিক নয়”
দুদক চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক সবুজ হোসেন জানান—
-
দুই কর্মচারীর নামেই কোনো উল্লেখযোগ্য সম্পদ নেই
-
কিন্তু তাঁদের স্ত্রীরা বিপুল সম্পদের মালিক
-
আয়কর নথি স্ত্রীদের নামে, স্বামীদের নামে নেই
-
অবৈধ সম্পদ লুকাতে স্ত্রীর নামকে ‘ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে
তদন্ত শেষে দুদক আদালতে অভিযোগপত্রও জমা দিয়েছে।
অভিযুক্তদের দাবি: “আমরা কোনো অবৈধ সম্পদ করিনি”
সেলিম হাওলাদার
তিনি দাবি করেন—
“আমার বা আমার স্ত্রীর নামে কোনো অবৈধ সম্পদ নেই।”
জাহানারা বেগম
“মা ও বোনের দানেই জমি পেয়েছি। স্বর্ণ বিক্রি বা সম্পদ কেনায় কোনো জালিয়াতি করিনি।”
আলমগীর লাতু
“আমি যে বেতন পেতাম তা দিয়ে সংসার চালানোতেই শেষ হয়ে যেত। জমি–বাড়ি স্ত্রীর বাবা ও ভাইয়ের অর্থে।”
হাসিনা বেগম
“সব কাগজপত্র আমার স্বামী দেখাশোনা করেন। আমি তেমন কিছু জানি না।”
দেশে অবৈধ সম্পদ লুকানোর সাধারণ কৌশলগুলো
এই মামলাটি বড় চিত্রের ছোট উদাহরণ। দুদকের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে—
অনেক সরকারি কর্মচারী—
-
স্ত্রী–সন্তানের নামে সম্পদ রাখেন
-
ভুয়া উপহার দেখান
-
জমির মূল্য কম দেখান
-
অস্তিত্বহীন দোকান দেখিয়ে আয় দেখান
-
কালো টাকা সাদা করতে কৌশল ব্যবহার করেন
জাহানারা–হাসিনা দুজনের বিষয়েও ঠিক একই কৌশলেরই প্রয়োগ দেখা গেছে।
আইন অনুযায়ী তাঁদের শাস্তি কী হতে পারে?
দুদকের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে—
১. মানিলন্ডারিং মামলা
২. দুর্নীতি দমন আইন অনুযায়ী জেল ও জরিমানা
৩. অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত
এ তিনটিই প্রযোজ্য হতে পারে।
শেষ কথা
চট্টগ্রামের দুই সাধারণ চাকরিজীবী পরিবারের গল্পটি সমাজে প্রচলিত একটি বড় প্রবণতাকে নতুন করে সামনে এনেছে।
স্বল্প বেতনের চাকরিজীবী হলেও শুধুমাত্র স্ত্রী-সন্তানের নামে সম্পদ রেখে নিজেদের অজান্তে কোটিপতি বানিয়ে ফেলা—এটি অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রমাণ করেছে দুদক।
যদিও অভিযুক্তরা অভিযোগ অস্বীকার করছেন, আদালতের রায়ই শেষ পর্যন্ত ঠিক করবে তারা দোষী কি না।
তবে এই ঘটনা স্পষ্ট করেছে—
দুর্নীতির পথ যত গোপনই হোক, তদন্তের সামনে তা আড়াল করার সুযোগ শেষ পর্যন্ত থাকে না।
