১ জন্মের বিপরীতে ৩ মৃত্যু—জনসংখ্যার তীব্র সংকটে ইউক্রেন
ইউক্রেনের জনসংখ্যা সংকট এখন শুধুমাত্র একটি পরিসংখ্যান নয়, এটি যুদ্ধের একটি দীর্ঘ ছায়া যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও তাড়া করে ফিরবে। রাশিয়ার আক্রমণের পর, দেশটির জনসংখ্যা কমতে শুরু করেছে এবং তা এখন এক ভয়ের দিকে চলে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যুদ্ধ এবং ব্যাপক অভিবাসনের ফলে ইউক্রেনের জনসংখ্যা খুব শীঘ্রই এমন সংকটে পড়তে চলেছে, যা শুধুমাত্র দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামোর ওপরই প্রভাব ফেলবে না, বরং ভবিষ্যতে পুনর্গঠন এবং প্রতিরক্ষা ক্ষমতাও বিপদে পড়বে।
যুদ্ধ ও অভিবাসনের বিপর্যয়
২০২২ সালের রাশিয়ার আক্রমণের পর, ইউক্রেনের জনসংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ২০ লাখ থেকে ৩ কোটি ৬০ লাখের নিচে নেমে গেছে। একদিকে, দেশটি যুদ্ধের কারণে বিপুল সংখ্যক পুরুষ ও তরুণকে হারিয়েছে, অন্যদিকে, অভিবাসন এবং প্রবাসী জনগণের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে দেশের জনসংখ্যা সংকুচিত হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে ইউক্রেনের পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বিপদ সৃষ্টি করতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকে, তবে ২০৫১ সালের মধ্যে ইউক্রেনের জনসংখ্যা মাত্র আড়াই কোটিতে নেমে আসতে পারে। এটি একটি ভীতিকর পরিস্থিতি, যেখানে দেশের কৌশলগত উন্নয়ন এবং নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জে পড়তে পারে।
ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে মৃত্যুর হার ও জন্মের হার
বর্তমানে ইউক্রেনের জনসংখ্যা সংকটের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হচ্ছে মৃত্যুহার এবং জন্মহার অনুপাত। সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুকের তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেনে এখন একটি জন্মের বিপরীতে তিনটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে—যা বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ অনুপাত। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, যুদ্ধের পরিণতি শুধু তরুণদের জীবনকেই বিপন্ন করছে না, বরং দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মকেও অনিশ্চিত করে তুলছে।
এছাড়া, ইউক্রেনের পুরুষদের গড় আয়ু এখন ৫৭.৩ বছর, যা পূর্বের তুলনায় অনেক কম। নারীদের ক্ষেত্রে, গড় আয়ু ৭৪.৪ থেকে নেমে ৭০.৯ বছরে চলে এসেছে। এই অস্থির পরিস্থিতি প্রমাণ করে যে, দীর্ঘকাল ধরে চলমান যুদ্ধে ইউক্রেনের জনসংখ্যা টিকে থাকতে পারছে না, এবং এটি দেশের ভবিষ্যতেও গভীর প্রভাব ফেলবে।
হশচা শহরের চিত্র
ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর হশচা একসময় সারা বছর জুড়ে ৪০০টি শিশুর জন্ম রেকর্ড করেছিল। তবে, ২০২৫ সালে সেখানে মাত্র ১৩৯টি শিশুর জন্ম হয়েছে। হশচা শহরের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ইয়েভহেন হেকেল জানান, “অনেক তরুণ মারা গেছেন, যাঁরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অংশ হওয়ার কথা ছিল।” যুদ্ধের ফলে হাজার হাজার তরুণ এবং পুরুষ প্রাণ হারিয়েছেন, যার ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বড় শূন্যস্থান তৈরি হচ্ছে।
হশচা শহরের যুদ্ধের ক্ষতি চিত্রিত হয়েছে শহরের দেয়ালে সাজানো নিহতদের ছবিতে। ২০২২ সালের পর এই অঞ্চলে ১৪১ জন লোক যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন। এসব মৃত্যুর ফলে শহরের জনসংখ্যার কাঠামো বিশালভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এবং এটি একটি মহামারি হয়ে উঠতে পারে। শহরজুড়ে তরুণদের অভাব দেখা যাচ্ছে, এবং এই অনুপস্থিতি ভবিষ্যতে সমাজে গভীর প্রভাব ফেলবে।
অভিবাসন এবং ভবিষ্যত প্রজন্ম
ইউক্রেনের যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের বিদেশে পাঠাচ্ছে, এবং দেশের স্কুলগুলো খালি হয়ে যাচ্ছে। হশচা শহরের কাছাকাছি সাদোভে গ্রামে শিক্ষার্থী সংখ্যা মাত্র ৯ জনে নেমে এসেছে, যা স্কুল বন্ধের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অভিবাসন এবং জনসংখ্যার হ্রাস, দেশের সেবা খাতে কর্মীর অভাব সৃষ্টি করবে, যা ইউক্রেনের ভবিষ্যতের জন্য একটি বড় সংকট।
এদিকে, যুদ্ধের পর দেশ পুনর্গঠন ও প্রতিরক্ষার জন্য লাখো কর্মী প্রয়োজন হবে, তাই ইউক্রেন সরকার ২০৪০ সাল পর্যন্ত একটি জনসংখ্যা পুনর্গঠন পরিকল্পনা করেছে। এই পরিকল্পনায় অভিবাসন কমানো, বিদেশে থাকা নাগরিকদের ফিরিয়ে আনা এবং প্রয়োজনে বিদেশি শ্রমিক আকৃষ্ট করার কথা বলা হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন যে, যদি বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকে, তবে ২০৪০ সালেও ইউক্রেনের জনসংখ্যা ২ কোটি ৯০ লাখের নিচে নেমে আসতে পারে।
অস্থিরতা এবং পরিবার গঠনের প্রতিবন্ধকতা
ইউক্রেনের বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি অনেক পরিবারকে সন্তান জন্মদানে অস্বীকৃতি জানাতে বাধ্য করছে। হশচার ২১ বছর বয়সী আনাস্তাসিয়া বলেন, “এখন পরিবার শুরু করা মানে অস্থির ভবিষ্যৎ। ঘরবাড়ির খরচ বেড়েছে, পরিকল্পনা করা অসম্ভব হয়ে গেছে।” দেশটির অস্থিরতা, যুদ্ধের ভয় এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা পরিবারের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে, তারপরও কিছু পরিবার সন্তান জন্ম দিতে চেষ্টা করছে, কারণ সন্তান এখন আশা ও জীবনের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
আনাস্তাসিয়া তাবেকোভা নামের এক স্থানীয় কর্মকর্তা জানান, তার স্বামী যখন যুদ্ধের জন্য ডাকা হয়, তখন তিনি গর্ভবতী ছিলেন। তিনি বলেন, “যখন জানলাম আমি গর্ভবতী, তখন কয়েক দিন পরই আমার স্বামীকে যুদ্ধে পাঠানো হয়।” এটি তার কাছে অত্যন্ত কঠিন একটি মুহূর্ত ছিল, তবে তবুও সন্তান তার জীবনের অন্যতম আনন্দের মুহূর্ত হয়ে উঠেছে।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
ইউক্রেনের এই জনসংখ্যা সংকট শুধু পরিসংখ্যানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, এটি একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট। যুদ্ধের দীর্ঘ ছায়া ইউক্রেনের ভবিষ্যত প্রজন্মকেও তাড়া করে যাবে, এবং দেশের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া কঠিন হতে পারে। তবে, সরকারের পরিকল্পনা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব হতে পারে, যদি দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হয়।
উপসংহার
ইউক্রেনের জনসংখ্যা সংকট দেশের নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও ভবিষ্যত সমাজের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি, যেখানে যুদ্ধের ফলস্বরূপ মৃত্যুহার বেড়েছে এবং জন্মহার কমেছে, তা আগামী দশকগুলোতে ইউক্রেনকে একটি বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিতে পারে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কৌশলগত পরিকল্পনা এবং দ্রুত পদক্ষেপ প্রয়োজন, তবে তা সহজ হবে না।
