ইউক্রেনের ড্রোন হামলার পর কায়রোস জাহাজের বাংলাদেশি নাবিকেরা বেঁচে ফিরলেন: এক ভয়াবহ অভিযানের বর্ণনা


২০২৫ সালের ২৮ নভেম্বর, কৃষ্ণসাগরে ইউক্রেনের নৌবাহিনী কর্তৃক চালানো এক ভয়াবহ ড্রোন হামলার পর এমটি কায়রোস নামে একটি তেল পরিবহনকারী জাহাজের ২৫ সদস্যের মধ্যে চারজন বাংলাদেশি নাবিক প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন। এই জাহাজটি তুরস্কের উপকূলের কাছে যখন কৃষ্ণসাগর অতিক্রম করছিল, তখনই প্রথম ড্রোন হামলা শুরু হয়। হামলার পর সাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশিতে দগ্ধ হয়ে আগুনের শিখা ছড়িয়ে পড়ে এবং ট্যাংকারের বিশাল অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এই ঘটনায় জাহাজের ২৫ জন নাবিকের মধ্যে চারজন বাংলাদেশি, যারা হলেন: মাহফুজুল ইসলাম (নরসিংদী), আল আমিন (কুষ্টিয়া), হাবিবুর রহমান (ঢাকা), এবং আজগর হোসাইন (চট্টগ্রাম), তাদের জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। হামলার পরে যেভাবে তারা বেঁচে ছিলেন, তা জানিয়ে তাদের বর্ণনা শুনলে যে কেউ ভয় পেয়ে যাবে।

হামলার মুহূর্ত:

বিবৃতিতে, মাহফুজুল ইসলাম জানাচ্ছেন যে, জাহাজে প্রথম হামলার পর প্রচণ্ড ঝাঁকুনি অনুভূত হয় এবং জাহাজের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। ঠিক এরপরেই দ্বিতীয় ড্রোন হামলা হয়, যেখানে তেল সংগ্রহের সিস্টেমে বিস্ফোরণ ঘটে এবং আগুন জ্বলে ওঠে। এ সময় জাহাজের সব নাবিকের মনে হত, বাঁচার আর কোনো উপায় নেই। তাদের সকলেই একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলেন, কারণ পরিস্থিতি ছিল অতিরিক্ত ভয়াবহ।

লাইফবোটের বিপদ:

এছাড়া, জাহাজের লাইফবোটের ব্যবস্থাও যথেষ্ট বিপদজনক ছিল। আগুন ও তেলের বিস্ফোরণ ছড়িয়ে পড়ায় লাইফবোটের কার্যক্রম ব্যাহত হয়। আল আমিন জানালেন, সাগরে আগুন ছড়িয়ে পড়ার পর তারা দ্রুত লাইফবোট নামানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু বাতাসের তীব্র গতির কারণে লাইফবোটে আগুন ধরে বিস্ফোরণ ঘটে।

তুরস্কের কোস্টগার্ডের ভূমিকা:

মাহফুজুল ইসলাম আরও বলেন, তুরস্কের কোস্টগার্ডকে জানানো হলে, তারা এক ঘণ্টার মধ্যে উদ্ধার অভিযানে আসে। কিন্তু আগুনের কারণে প্রথমে বাণিজ্যিক জাহাজটি এসে উদ্ধার করতে পারেনি। একপর্যায়ে, কোস্টগার্ডের প্রচেষ্টায় তাদের জীবিত উদ্ধার করা হয়।

অভিযোগ ও আন্তর্জাতিক সহায়তা:

এই ঘটনাটি ঘটানোর জন্য ইউক্রেনের নৌবাহিনীর ড্রোন হামলার তীব্র সমালোচনা হয়েছে আন্তর্জাতিক মহলে। একইসঙ্গে, বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনও তুরস্কের সাথে যোগাযোগ করে তাদের সহযোগিতার জন্য আহ্বান জানায়। সাখাওয়াত হোসেন, সাধারণ সম্পাদক জানান, "এটা নিঃসন্দেহে একটি বেঁচে থাকার সংগ্রাম ছিল। আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর সহায়তা ছাড়া বাংলাদেশি নাবিকদের বাঁচানো সম্ভব ছিল না।"

অতীতের স্মৃতি:

এর আগে ২০২২ সালের মার্চ মাসে ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে রাশিয়ার মিসাইল হামলায় 'বাংলার সমৃদ্ধি' নামের এক বাংলাদেশি জাহাজ আক্রমণের শিকার হয়েছিল, যেখানে ২৮ বাংলাদেশি নাবিককে উদ্ধার করা হয়েছিল। সেই ঘটনায়, প্রকৌশলী হাদিসুর রহমান নিহত হন, কিন্তু এবার তাৎক্ষণিক পদক্ষেপে কোনও প্রাণহানি হয়নি।

উপসংহার:

এই ঘটনাটি কেবলমাত্র সাগরের বাণিজ্যিক নাবিকদের জন্য নয়, বরং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ক্ষেত্রেও এক বড় প্রশ্ন চিহ্ন রেখে গেছে। ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে চলমান যুদ্ধের জেরে, জলপথের নিরাপত্তা প্রশ্নে বিভিন্ন দেশের নৌবাহিনীর তৎপরতা আরও বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশি নাবিকদের জন্য এ ঘটনা একটি বড় শিক্ষা, এবং তাদের সাহসিকতা ও সংকটময় পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার লড়াই বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

গিনি-বিসাউয়ে সামরিক হস্তক্ষেপ: প্রেসিডেন্ট ও নেতাদের আটক, নির্বাচনী পরিস্থিতি স্থগিত

এমটি কায়রোসে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা: কেমন আছেন বাংলাদেশি নাবিকরা?

তারেক রহমান দেশে ফিরতে পারছেন না কেন? দেশের বাইরে থাকা নেতার আসল সত্য!