ভারত কেন আইএমএফ-এর 'সি' গ্রেড পেলো, যদিও জিডিপি বেড়েছে?


ভারতের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে অনেক আলোচনা চলছে। সম্প্রতি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দাবি করেছেন যে, ভারতের জিডিপি ৮.২ শতাংশ বেড়েছে, যা গত বছরের তুলনায় বেশ ভালো। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেনি, তবে তাদের প্রতিবেদনে ভারতকে ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টস স্ট্যাটিস্টিক্সের জন্য 'সি' গ্রেড দিয়েছে। এর পেছনে কী কারণ রয়েছে, এবং কেন এমন বিতর্ক উঠেছে, তা নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির দাবি

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ভারতের প্রকৃত জিডিপি ৮.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৫.৬ শতাংশ। মোদী সরকার ভারতকে এক গতিশীল অর্থনীতি হিসেবে তুলে ধরছে, এবং এর মাধ্যমে তাদের উন্নতির সূচক হিসেবে জিডিপির বৃদ্ধিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

এদিকে, বিজেপি সরকার দাবি করছে, ভারত তার অর্থনৈতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে, এবং এর কারণে তাদের আনুমানিক ৭.৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের জিডিপি পৌঁছেছে। তবে, এই বৃদ্ধির দাবি ও সরকারের প্রকাশিত তথ্য সত্ত্বেও আইএমএফ ভারতকে কেন ‘সি’ গ্রেড দিয়েছে, তা নিয়ে জোর বিতর্ক চলছে।

আইএমএফের 'সি' গ্রেডের কারণ

আইএমএফ তাদের 'ইন্ডিয়া: ২০২৫ আর্টিকেল ফোর কন্সালটেশন' শীর্ষক প্রতিবেদনে ভারতের ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টস স্ট্যাটিস্টিক্সের মানকে ‘সি’ গ্রেড দিয়েছে। 'সি' গ্রেড অর্থাৎ, পর্যবেক্ষণের জন্য তথ্যের কিছু ঘাটতি রয়েছে, যা পরবর্তী বিশ্লেষণের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে।

আইএমএফ জানিয়েছে যে ভারতের ব্যবহৃত ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টস স্ট্যাটিস্টিক্স থেকে উপস্থাপিত তথ্যের যথেষ্ট গুণগত মান নেই। ফ্রিকোয়েন্সি সঠিক হলেও, তথ্যে কিছু ত্রুটি রয়েছে যা বিশ্লেষণ এবং অর্থনৈতিক মূল্যায়নের জন্য বাধা সৃষ্টি করে।

আইএমএফ জানায়, ভারত তার ভিত্তিবর্ষ হিসেবে ২০১১-২০১২ সালকে ধরে রেখেছে, যা বর্তমানে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। ২০১১ সাল পরবর্তী অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানগুলো সরকারের কাছে উপলব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি হলেও তা আজকের বাস্তবতার সঙ্গে মিলছে না। এছাড়া, ভারত উৎপাদক মূল্য সূচক (PPI) ব্যবহার না করে পাইকারি মূল্য সূচক (WPI) ব্যবহার করছে, যার ফলে তথ্যের মধ্যে পার্থক্য দেখা যেতে পারে।

আইএমএফ আরও জানিয়েছে, ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য কিছুটা সীমাবদ্ধ, বিশেষত নন-ব্যাংকিং ফিনান্সিয়াল কোম্পানির (এনবিএফসি) তথ্য এবং দেশটির অসংগঠিত খাত (informal sector) সম্পর্কিত সঠিক পরিসংখ্যানের অভাব রয়েছে।

বিজেপি ও কংগ্রেসের রাজনৈতিক পাল্টা অভিযোগ

এ বিষয়ে বিজেপি সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, আইএমএফ-এর প্রতিবেদনে কোনো গলদ নেই, বরং তথ্য ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তিগত কারণে এই ‘সি’ গ্রেড দেওয়া হয়েছে। বিজেপির পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে যে, ২০১১-২০১২ সালকে ভিত্তিবর্ষ হিসেবে ধরে নেওয়া একটি প্রযুক্তিগত সমস্যা, এবং এই ‘সি’ গ্রেড দীর্ঘদিন ধরে অপরিবর্তিত রয়েছে।

কংগ্রেস দলের পক্ষ থেকে যদিও এই প্রতিবেদন নিয়ে সরব হয়েছে। পি চিদাম্বরম, ভারতের সাবেক অর্থমন্ত্রী, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন তুলেছেন, “আইএমএফ কেন ভারতের তথ্যকে 'সি' গ্রেড দিয়েছে, যদিও সরকার দাবি করছে জিডিপি বেড়েছে?” তারা সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছে, তথ্যের সঠিকতা নিশ্চিত করা এবং জিডিপি গণনায় আরো স্বচ্ছতা আনা

কংগ্রেসের নেত্রী সুপ্রিয়া শ্রীনাথ বলেছেন, "আইএমএফ জানিয়েছে, ভারতের ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টস এবং মুদ্রাস্ফীতি সম্পর্কিত পরিসংখ্যান কিন্তু ইনফর্মাল সেক্টর এবং জনগণের ব্যয়ের প্রকৃত অবস্থা প্রতিফলিত করে না।" তাদের মতে, অসংগঠিত খাতের তথ্যের অভাব এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধকতার কারণে জিডিপি হিসাব ভুল হয়ে যেতে পারে

বিশেষজ্ঞদের মতামত

এখন, অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা এই বিতর্কের কেন্দ্রে আছেন। অরুণ কুমার, দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “ভারতের জিডিপি পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে, বিশেষ করে যখন সরকার একটি বয়সী ভিত্তিবর্ষ ব্যবহার করছে এবং অন্যান্য খাতের তথ্য সঠিকভাবে উপস্থাপন করছে না।”

বিশেষজ্ঞদের মতে, নোট বাতিল, জিএসটি, এবং কোভিড মহামারী ভারতীয় অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে, বিশেষ করে অসংগঠিত খাত বা ছোট ব্যবসা। তার মতে, সরকার এসব খাতের তথ্যের সঠিক মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে, এবং এর ফলে জিডিপির হিসাবেও কিছু ভুল থাকতে পারে।

অর্থনীতিবিদরা আরো জানান, তথ্য ব্যবস্থাপনা ঠিক না হলে, সঠিক অর্থনৈতিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়। বিশেষ করে, অসংগঠিত খাত (যেখানে ৯০ শতাংশ কর্মী কাজ করেন) এর ওপর উপযুক্ত মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।

উপসংহার: আইএমএফ-এ 'সি' গ্রেড, ভারতের জিডিপি হিসাব এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ

ভারতের ‘সি’ গ্রেড গ্রেডের প্রতিবেদন নিয়ে তীব্র বিতর্ক এবং সমালোচনা চলছে। যদিও ভারতের সরকারের দাবি, অর্থনীতি গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে আইএমএফ-এর প্রতিবেদনে বিশেষভাবে তথ্যের ঘাটতি এবং সঠিক বিশ্লেষণের অভাবের কথা বলা হয়েছে। এর ফলে সরকারি তথ্যের সঠিকতা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এখন দেখা উচিত, ভারত সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, এবং কিভাবে এই 'সি' গ্রেড সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে, যাতে আগামী দিনে আরও ভালো অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ এবং উন্নতি সম্ভব হয়।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

গিনি-বিসাউয়ে সামরিক হস্তক্ষেপ: প্রেসিডেন্ট ও নেতাদের আটক, নির্বাচনী পরিস্থিতি স্থগিত

এমটি কায়রোসে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা: কেমন আছেন বাংলাদেশি নাবিকরা?

তারেক রহমান দেশে ফিরতে পারছেন না কেন? দেশের বাইরে থাকা নেতার আসল সত্য!