পুতিনের ভারত সফরে মোদির অপ্রত্যাশিত কোলাকুলি: প্রটোকল ভেঙে সম্পর্কের নতুন দিগন্ত


ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সম্পর্কটি কখনোই সাধারণ ছিল না। দীর্ঘদিনের কৌশলগত বন্ধু, দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক, সামরিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক অটুট। তবে, ৪ ডিসেম্বর ২০২৫-এ পুতিনের দিল্লি সফরটি শুধু তার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক দিকেই আলোকপাত করছে না, বরং ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের নতুন একটি দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। মোদি যখন বিমানবন্দরে ব্যক্তিগতভাবে পুতিনকে স্বাগত জানান, তখন তিনি এক ধরনের প্রতীকী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যা ঐতিহ্যগত প্রটোকল ভেঙে গেছে এবং এটি বিশ্ব রাজনীতিতে কিছুটা বিস্ময় সৃষ্টি করেছে।

প্রটোকল ভাঙার সাহসিকতা

প্রথমে, মোদির এই পদক্ষেপ ভারতীয় রাজনীতির প্রটোকল অনুযায়ী ছিল অবিশ্বাস্য। ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের সফরের ক্ষেত্রে সাধারণত রাষ্ট্রীয় প্রটোকল মেনে চলা হয়, যেখানে সরকারিভাবে প্রস্তুতকৃত প্রতিনিধিরা সফরকারী রাষ্ট্রের প্রধানকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানান। তবে, মোদির এই পদক্ষেপ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের চোখে অদ্ভুত হলেও, এটি ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের জন্য একটি গভীর অর্থ বহন করে।

স্পুটনিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুতিনকে বিমানবন্দরে বরণ করার আগে ভারতীয় প্রশাসন রাশিয়ার পক্ষকে জানায়নি। এক্ষেত্রে, মোদি ব্যক্তিগতভাবে পুতিনকে স্বাগত জানিয়ে এবং তার সঙ্গে করমর্দন ও আলিঙ্গন করে প্রটোকল ভেঙেছেন। এই ধরনের বিনম্র ও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ একদিকে যেমন ব্যক্তিগত সম্পর্কের এক নতুন মাত্রা স্থাপন করে, তেমনি রাষ্ট্রীয় কূটনীতির মধ্যে একটি গা-ছমছমে মুহূর্ত সৃষ্টি করেছে।

পুতিন-মোদির সম্পর্ক: রাজনৈতিক সমীকরণ

নরেন্দ্র মোদি ও ভ্লাদিমির পুতিনের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে বন্ধুত্বপূর্ণ, কিন্তু ২০২২ সালে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর, রাশিয়া এবং ভারতের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক কিছুটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। রাশিয়া ভারতকে অস্ত্র সরবরাহ করে, এবং ভারতও রাশিয়া থেকে তেল ও গ্যাস আমদানিতে ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।

যেহেতু মোদি ও পুতিনের মধ্যে সম্পর্ক মূলত সুরক্ষিত একটি কৌশলগত বন্ধুত্বের মতো, তাদের এই সম্পর্ক দুই দেশের জন্য সমর্থনযোগ্য এবং ব্যবসায়িকভাবে ফলপ্রসূ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে, ভারত-রাশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং দুই দেশের কৌশলগত সহযোগিতা নতুন দিক নিয়েছে।

পুতিনের ভারত সফর: বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতায় জোর

৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় দিল্লি পৌঁছানোর পর, পুতিন দুই দিনের সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে বৈঠক করবেন। এই সফরের মূল লক্ষ্য হলো বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও মজবুত করা, বিশেষ করে ভারত রাশিয়ার থেকে সামুদ্রিক পণ্য, ভোক্তাসামগ্রী, ওষুধ এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানি বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। অন্যদিকে, ভারত এখনও রাশিয়ার সার আমদানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল এবং এই সহযোগিতা আরও গভীর করার পরিকল্পনা রয়েছে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী ৫ ডিসেম্বর পুতিন-মোদি বৈঠকে বাণিজ্য, অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং রাশিয়া-ভারত সম্পর্কের ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা হবে। ২০২২ সালে ভারত রাশিয়ার থেকে ১৮ বিলিয়ন ডলারের অধিক রপ্তানি এবং বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে। রাশিয়া ভারতকে বিশেষ করে সার এবং অন্যান্য কাঁচামাল সরবরাহের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।

দুই নেতা একসাথে: টয়োটা ফর্চুনার গাড়িতে সফর

পুতিন যখন দিল্লি পৌঁছান, তখন মোদি তাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানিয়ে এক সাদাসিধে পদক্ষেপ নেন—সুপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় গাড়ির পরিবর্তে তারা একটি টয়োটা ফর্চুনার গাড়িতে সফর করেন। এই ধরনের সাধারণ গাড়িতে সফর করা অনেকের কাছে একটি চমকপ্রদ ব্যাপার, যেহেতু একদিকে এটা নিরাপত্তার দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, অন্যদিকে এটি তাদের সম্পর্কের এক অসাধারণ বন্ধুত্বের নিদর্শন। এই দৃশ্যটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক শীর্ষে থাকা সত্ত্বেও, এই সম্পর্ক ব্যক্তিগত স্তরে উন্মুক্ত এবং আন্তরিক।

এই পদক্ষেপটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, যখন ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সম্মেলনে পুতিন মোদিকে তার সরকারি গাড়িতে সফর করিয়েছিলেন।

ভারতের পররাষ্ট্রনীতি: ভারতীয় রাজনীতিতে একটি মাইলফলক

ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের এই নতুন মোড় শুধুমাত্র বাণিজ্য এবং অর্থনীতির দিকে সীমাবদ্ধ নয়; এটি ভারতের পররাষ্ট্রনীতির একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিতও হতে পারে। বর্তমানে ভারত পশ্চিমা দেশগুলির থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, এবং ভারত রাশিয়ার সঙ্গে তার কৌশলগত সম্পর্ক আরও জোরালো করতে চাইছে। পুতিনের ভারত সফরের মাধ্যমে, দুই দেশ আরও কিছু যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে, যা ভবিষ্যতে বাণিজ্য এবং নিরাপত্তা চুক্তির আওতায় নতুন দিক উন্মোচন করবে।

উপসংহার

ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মতো একজন রাষ্ট্রনায়ক যখন প্রটোকল ভেঙে তার বিদেশি অতিথিকে এমন আন্তরিকতার সাথে স্বাগত জানান, এটি কেবল ব্যক্তিগত সম্পর্ক নয়, বরং রাষ্ট্রীয় সম্পর্কেরও একটি নতুন মাত্রা। পুতিনের ভারত সফরের মাধ্যমে শুধু ব্যবসায়িক সম্পর্কই বৃদ্ধি পাবে না, বরং দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। এটি ভারত-রাশিয়ার সম্পর্কের এক নতুন মাইলফলক হতে পারে, যা আগামী দিনে আরও শক্তিশালী হবে।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

গিনি-বিসাউয়ে সামরিক হস্তক্ষেপ: প্রেসিডেন্ট ও নেতাদের আটক, নির্বাচনী পরিস্থিতি স্থগিত

এমটি কায়রোসে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা: কেমন আছেন বাংলাদেশি নাবিকরা?

তারেক রহমান দেশে ফিরতে পারছেন না কেন? দেশের বাইরে থাকা নেতার আসল সত্য!