এক পরিবারের দুই ভাইকে মনোনয়ন: বিএনপি ভাঙল নিজস্ব নীতি
২০২৫ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি নিজেদের প্রার্থীদের তালিকা ঘোষণা করেছে। তবে এই তালিকা প্রকাশের সঙ্গে একটি বড় চমক দেখা গেছে, যা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের নজর কেড়েছে। বিএনপি ঘোষিত নির্বাচনী নীতির বিপরীতে, এক পরিবারের দুটি সদস্যকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, যা দলটির পূর্ব ঘোষিত নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এই পরিবর্তন একদিকে যেমন রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা সৃষ্টি করেছে, তেমনি দলের ভেতরও নানা প্রশ্ন তুলেছে।
বিএনপির প্রার্থী মনোনয়ন নীতি: এক পরিবারের এক প্রার্থী
২০১৮ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি একটি নতুন নীতি ঘোষণা করে, যেখানে বলা হয়, "এক পরিবার থেকে শুধু একজনই প্রার্থী হবে।" দলের নেতৃত্বের এই সিদ্ধান্ত ছিল একটি চ্যালেঞ্জিং কিন্তু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ, যাতে পরিবারের সদস্যরা দলের মধ্যে একাধিক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করেন এবং দলের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি না হয়। এই নীতি দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশে নেওয়া হয়, যাতে দলের প্রার্থীরা সবসময় দলীয় ঐক্য এবং সমন্বয়ের মধ্যে থেকে নির্বাচনে অংশ নেন।
তবে এবার, আসন্ন ২০২৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে, বিএনপি এই নীতি ভেঙে দুই ভাইকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে, যা দলটির রাজনৈতিক দর্শন এবং নীতির ওপর প্রশ্ন তুলেছে। ২০২৫ সালের ৪ ডিসেম্বর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলনে টাঙ্গাইল জেলার প্রার্থীদের তালিকা ঘোষণা করেন, এবং সেখানে দুটি আসনে দুই ভাইয়ের নাম ঘোষণা করা হয়—আব্দুস ছালাম পিন্টু এবং সুলতান সালাউদ্দিন টুকু।
টাঙ্গাইল-২ এবং টাঙ্গাইল-৫ আসনে দুই ভাইয়ের মনোনয়ন
বিএনপির ঘোষিত তালিকার মধ্যে টাঙ্গাইল-২ এবং টাঙ্গাইল-৫ আসনে দুই ভাইকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। টাঙ্গাইল-২ আসনে আব্দুস ছালাম পিন্টু এবং টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনে দলের প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন। এই ঘোষণা, যা দলীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলনে করেছেন, তাতে নিশ্চিত হয়ে গেছে যে একই পরিবারের দুই সদস্য একই সময়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
টাঙ্গাইল জেলার আটটি আসনের মধ্যে, প্রথম দফায় সাতটি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনটি ছিল শূন্য, যার কারণে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। সুলতান সালাউদ্দিন টুকু এবং অ্যাডভোকেট ফরহাদ ইকবালের সমর্থকদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে উদ্বেগ ছিল, কিন্তু বৃহস্পতিবার সেই উৎকণ্ঠা শেষ হয়ে, টুকুকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
নীতির বাইরেও কেন এই সিদ্ধান্ত?
বিএনপির নির্বাচনী নীতি অনুযায়ী, এক পরিবার থেকে একাধিক সদস্যকে প্রার্থী করা বিরোধী দলের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করতে পারে, এবং দলীয় ঐক্যকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে—এমন একটি ধারণা দলের অভ্যন্তরে ছিল। তবুও, টাঙ্গাইল জেলার প্রেক্ষাপটে দুই ভাইকে মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়টি কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ পদক্ষেপের পিছনে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা কিংবা রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকতে পারে। স্থানীয় নির্বাচনী পরিস্থিতি, ঐতিহাসিক ভোটব্যাংক এবং রাজনৈতিক সমর্থন বিবেচনায় নেওয়া হলে, কখনও কখনও দলের নীতির বাইরে গিয়ে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। আরও কিছু সূত্রের মতে, টাঙ্গাইল-৫ আসনে ফরহাদ ইকবালের সমর্থকদের মধ্যে দলের ভেতর বিভক্তি সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে, সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর প্রার্থী হওয়া দলের জন্য নির্বাচনী সমঝোতা এবং ঐক্য বজায় রাখার একটি উপায় হিসেবে দেখা যেতে পারে।
নির্বাচনী প্রতিযোগিতা: দুই ভাইয়ের মুখোমুখি লড়াই
তবে, যেহেতু এক পরিবারের দুই সদস্যের মধ্যে নির্বাচনী প্রতিযোগিতা হবে, তাই এটা দৃষ্টিগোচর হবে কীভাবে তারা নিজেদের নির্বাচনী অঞ্চলগুলোতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। যদিও একই পরিবার থেকে দুটি প্রার্থী আসছে, তবে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাদের নিজ নিজ রাজনৈতিক ভূমিকা এবং দলের প্রতি আনুগত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে আকর্ষণীয় হতে পারে।
এছাড়া, দুই ভাইয়ের নির্বাচনী লড়াই বিএনপির টাঙ্গাইল জেলা শাখার মধ্যে নতুন রাজনৈতিক দিশা তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে, স্থানীয় রাজনীতি, নেতা-কর্মীদের মধ্যে সমর্থন এবং ভোটব্যাংকের ওপর এই দায়িত্বের প্রভাব পড়বে। এই লড়াইয়ে, দলীয় সমর্থকরা, বিশেষ করে টুকু এবং পিন্টুর সমর্থকরা তাদের ভোটের সিদ্ধান্ত নিয়ে আরও সক্রিয় হতে পারে।
বিএনপির আগামী দিনগুলো: অভ্যন্তরীণ সমন্বয় বা বিভাজন?
দলটি একদিকে যেখানে আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেখানে অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও সমন্বয়ের প্রশ্নও উঠছে। নীতির পরিবর্তন এবং এক পরিবারের দুই ভাইয়ের মনোনয়ন বিএনপির শীর্ষ নেতাদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। যদি এই মনোনয়ন দলের ঐক্যকে সমর্থন দেয়, তবে এটি দলের জন্য লাভজনক হতে পারে। তবে যদি এটি বিভাজন সৃষ্টি করে, তবে দলের নির্বাচনী জয়ের সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
উপসংহার
বিএনপির নির্বাচনী নীতি ভেঙে এক পরিবারের দুই ভাইকে মনোনয়ন দেওয়ার সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক অঙ্গনে এক নতুন আলোচনার সূচনা করেছে। এটি দলের অভ্যন্তরীণ সমন্বয় এবং ভোটব্যাংক তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে, তবে এটি দলীয় নীতির প্রতি প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্নও তুলছে। এখন দেখার বিষয় হলো, এই সিদ্ধান্ত নির্বাচনী ফলাফল কেমন প্রভাব ফেলবে, এবং বিএনপি এই অবস্থায় কীভাবে নিজেদের ঐক্য বজায় রাখে।
